Advertisement
২১ মে ২০২৪
শিশুপণ্য-১

সাদা পথে দ্রুত না মেলায় কালোবাজারেই কেনা হত শিশু

উত্তর ২৪ পরগনার ইছাপুরের বাসিন্দা বেসরকারি কর্মী সুবীর মুখোপাধ্যায় (নাম পরিবর্তিত) নিঃসন্তান। সন্তান দত্তক নেবেন বলে ২০১৪ সালে কেন্দ্রের ‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টের’ মাধ্যমে ‘স্পেশ্যাল অ্যাডপশন এজেন্সি’ (সা)-র কাছে আবেদন করেছেন।

দীক্ষা ভুঁইয়া
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৪
Share: Save:

উত্তর ২৪ পরগনার ইছাপুরের বাসিন্দা বেসরকারি কর্মী সুবীর মুখোপাধ্যায় (নাম পরিবর্তিত) নিঃসন্তান। সন্তান দত্তক নেবেন বলে ২০১৪ সালে কেন্দ্রের ‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টের’ মাধ্যমে ‘স্পেশ্যাল অ্যাডপশন এজেন্সি’ (সা)-র কাছে আবেদন করেছেন। এখনও দত্তক পাননি।

ওই আইনেই ফর্ম পূরণ করে বছর খানেক ধরে অপেক্ষা করে রয়েছেন বাগুইআটির এক দম্পতিও। তাঁরাও এখনও দত্তক পাননি।

আইনি পথে দত্তক পেতে এত দেরি হওয়ার কারণেই শিশুদের নিয়ে ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। এ রাজ্যে শিশু দত্তক নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন, এমন দম্পতির সংখ্যাটা অন্তত কয়েক হাজার। কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, রাজ্যে দত্তক দেওয়ার মতো অনাথ শিশু রয়েছে ৭৬টি! ইছাপুরের সুবীরবাবু সন্তান দত্তক নেবেন বলে যখন আবেদন করেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন ১০১১ জনের পরে। বাগুইআটির দম্পতি অবশ্য দত্তক নেওয়ার জন্য ডাক পেয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট জেলার সরকার অনুমোদিত ‘সা’ (স্পেশ্যাল অ্যাডপশন এজেন্সি) থেকে। তবু সন্তান নিয়ে ফিরতে পারেননি দম্পতি। কেন? ওই দম্পতি জানান, তাঁদের একটিই শিশু দেখানো হয়েছিল। কিন্তু শিশুটির মানসিক সমস্যা ছিল। তাই তাঁরা নেননি। সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় তাঁরা ফের ফর্ম পূরণ করে অপেক্ষায় রয়েছেন।

রাজ্য সরকারের দাবি, কেন্দ্রের ‘সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি’-র পোর্টালে রাজ্যের বিভাগে ঢুকে অনলাইনে ফর্ম পূরণ এবং তার পরে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কোল ভরাতে পারেন নিঃসন্তান দম্পতি। এ জন্য দিতে হয় মাত্র ৪৬ হাজার টাকা। কিন্তু ভুক্তভোগীরা বলছেন, ব্যবস্থা নামেই। সেখানে চাইলেই শিশু মেলে না। আবার সব সময়ে সদ্যোজাতও মেলে না। মেলে কয়েক মাস বা তার বেশি বয়সের শিশু। সেটা আবার অনেকে মেনে নিতে পারেন না। শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের কর্তাদের দাবি, এ ক্ষেত্রে রাজ্যের কিছু করার নেই। পুরোটাই কেন্দ্রীয় ভাবে পরিচালিত হয়। রাজ্য শুধু নিজেদের হাতে থাকা অনাথ শিশুদের তথ্য পোর্টালে তুলে দেয়। ‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট’ অনুযায়ী ‘সা’-র মাধ্যমে আগে অনেক বাচ্চা বিক্রির অভিযোগ ওঠায় ২০১৫ সালে কেন্দ্র তার বদলে ‘সেন্ট্রাল অ্যাডপশন অ্যান্ড মেনটেন্যান্স অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে অনলাইনে দত্তক নেওয়ার নিয়ম জারি করে।

অর্থাৎ শিশু পাচার রুখতে কাগজ-কলমে হলেও প্রশাসন রয়েছে। আইনও রয়েছে। কিন্তু সেই আইনেরই দীর্ঘসূত্রিতায় শিশু দত্তক পেতে দম্পতিরা যেমন নাকাল হচ্ছেন, তেমনই রয়েছে ওই আইন সংক্রান্ত প্রচারের অভাব। এই সব ফাঁক গলেই শিশু-কারবারিরা ইদানীং বিশেষ কেন্দ্রীয় আইন ‘হিন্দু অ্যাডপশন অ্যান্ড মেনটেন্যান্স অ্যাক্ট ১৯৫৬’ (হামা)-কে হাতিয়ার করে রমরমিয়ে ব্যবসা করে চলেছে বলে মনে করছেন শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিকেরা। ওই আইনে কুমারী মা, বিধবা মা বা প্রতিপালন করতে পারছেন না এমন মা, তাঁর সন্তানকে আদালতে নিয়ে এসে সরকারের হাতে তুলে দিতে পারেন। এমনকী আদালতে বিচারকের সামনে কোনও মহিলা দত্তক নিতে ইচ্ছুক, এমন কারও হাতেও নিজের সন্তান তুলে দিতে পারেন। পাচারকারীরা অতএব শিশু এনে নকল মা-কে আদালতে দাঁড় করিয়ে ব্যবসা করে চলেছে বলে। আর গোপন পথে বাড়তি টাকা গুনতে হলেও ঘরে শিশু আসায় হাসি ফুটছে নিঃসন্তান দম্পতির মুখে। রাজ্যের শিশু ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজা অবশ্য দাবি করেছেন, হামা-আইনে কোনও শিশু দত্তক নেওয়া যায় বলে তাঁর জানা নেই। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘দত্তকের জন্য যখন যেমন অনাথ শিশু মেলে, সঙ্গে সঙ্গেই তা কেন্দ্রকে জানিয়ে দেওয়া হয়।’’ এই নিয়মকে যথাযথ বলে দাবি করে কলকাতা সংলগ্ন একটি জেলার শিশু সুরক্ষা আধিকারিক বলেন, ‘‘নতুন আইনের তেমন প্রচার না থাকায় অনেকেই ভুল পথে টাকার বিনিময়ে সন্তান কিনতে যান। অথচ প্রতিটি জেলার শিশু কল্যাণ সমিতির কাছ থেকেই তাঁরা সাহায্য পেতে পারেন।’’

কিন্তু পদ্ধতিটা যে সময়সাপেক্ষ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্প্রতি রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটি শিশুকে দত্তক নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল এ রাজ্যে। কিন্তু এখনও কেউই তাকে দত্তক নিতে পারেননি। শিশুটিকে রাখা হয়েছে কলকাতার একটি হোমে। কেন? প্রশাসন জানিয়েছে, সাধারণত কোনও শিশুকে কুড়িয়ে পাওয়ার পরে তার ছবি দিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করতে হয় জেলার শিশু কল্যাণ সমিতিকে। সদ্যোজাত হলে দু’মাস এবং বাকিরা তিন মাস পর্যন্ত শিশুটি তাদের হেফাজতেই থাকে। তার মধ্যে তাকে কেউ দাবি না করলে তবে ‘অনাথ’ ঘোষণা করে দত্তকের জন্য কেন্দ্রীয় পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করা হয়।

ফল? সরকারি নিয়মের বেড়াজালে ভুগতে হচ্ছে নিঃসন্তান দম্পতিকে। বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে শিশু-কারবারিদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE