Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মমতা কী বলেন, আগ্রহী অপেক্ষা সিঙ্গাপুরে

সকালে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে নেমে হোটেলের ঘরে একটু বিশ্রাম। তার পর সারা দিন কখনও নেতাজি স্মারক, কখনও পাখি বিতান সফর। এক ফাঁকে রামকৃষ্ণ মিশনেও ঘুরে আসা। সিঙ্গাপুর সফরের প্রথম দিনটা এ ভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে তাঁর এই সফর ঘিরে উৎসাহ তৈরি হয়েছে স্থানীয় বণিকমহলে। শিল্প সম্মেলনের এক সংগঠকের দাবি, এ দেশের বণিকসভাগুলি লগ্নি ও শিল্প নিয়ে মমতার কথা শুনতে যথেষ্টই আগ্রহী। আগ্রহ এতটাই যে আমন্ত্রণপত্র বিলি শেষ হওয়ার পরেও আরও এক বার তা চালু করতে হয়েছে।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
সিঙ্গাপুর শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪১
Share: Save:

সকালে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে নেমে হোটেলের ঘরে একটু বিশ্রাম। তার পর সারা দিন কখনও নেতাজি স্মারক, কখনও পাখি বিতান সফর। এক ফাঁকে রামকৃষ্ণ মিশনেও ঘুরে আসা। সিঙ্গাপুর সফরের প্রথম দিনটা এ ভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে তাঁর এই সফর ঘিরে উৎসাহ তৈরি হয়েছে স্থানীয় বণিকমহলে। শিল্প সম্মেলনের এক সংগঠকের দাবি, এ দেশের বণিকসভাগুলি লগ্নি ও শিল্প নিয়ে মমতার কথা শুনতে যথেষ্টই আগ্রহী। আগ্রহ এতটাই যে আমন্ত্রণপত্র বিলি শেষ হওয়ার পরেও আরও এক বার তা চালু করতে হয়েছে।

সদ্যই ভারত-সিঙ্গাপুর কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী পর্বের সূচনা করে দিল্লি ফিরেছেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তার রেশ মিটতে না মিটতেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সফর। সেই সফর ঘিরে উৎসাহের কারণ কী? বিষয়টা খোলসা করতে গিয়ে দেশের এক বণিকসভার কর্তার বক্তব্য, কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের বিদেশমন্ত্রীর সফর নিয়ে সিঙ্গাপুরের নানা মহলে আগ্রহ ছিলই। তার উপর দিল্লিতে নতুন সরকার আসার পর নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে আশার আলো দেখছে এখানকার শিল্প সংস্থাগুলি। সেই আবহেই মমতা এ দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সিঙ্গাপুর সরকারও অতি দ্রুত এই সফরের ছাড়পত্র দিয়েছে। এই বিষয়েবণিকমহলে জোর চর্চা শুরু হয়েছে।

আয়োজক বণিকসভাগুলির দাবি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্প সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি জানতে সিঙ্গাপুর সরকারও উৎসাহী। দিল্লিতে মোদীর নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পরে এ দেশের বণিকমহলও ভারতকে বিনিয়োগের নতুন গন্তব্য হিসেবে বেছে নিচ্ছে। তার মধ্যেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গও। আয়োজক বণিকসভাগুলির দাবি, মমতার এই সফরের জন্যই সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর দফতর রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে এবং মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের সফরসূচি কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে। মমতাকে এখানকার শিল্পপতিদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগও করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে লি-র নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব এক বাক্যে মেনে নেন বিশ্ব নেতারা। সিঙ্গাপুরের জাতীয় দিবসের বক্তৃতায় এ দেশকে ‘স্মার্ট নেশন’ করার কথা ঘোষণা করেছেন লি। এখানকার সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে যথেষ্ট উন্মাদনা রয়েছে। এই ‘স্মার্ট নেশন’ গঠন করতে গেলে সিঙ্গাপুরের যেমন তথ্যপ্রযুক্তি বা গবেষণা ক্ষেত্রে আরও মেধা চাই, তেমনই চাই এখানকার সরকারি বা সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলির জন্য লাভজনক বিনিয়োগের জায়গা। লি সিয়েন লুং সেই লক্ষ্যেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছেন। মমতার সফরকে তারই অঙ্গ হিসেবে ধরা হচ্ছে।

বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর শিল্প সম্মেলনে প্রায় ১৫০টি ছোট-বড়-মাঝারি শিল্প সংস্থার কর্তা হাজির থাকবেন বলে জানা গিয়েছে। এই অনুষ্ঠানের জন্য রাজ্য সরকার ভারতীয় হাইকমিশন, ইন্ডিয়া-সিঙ্গাপুর চেম্বার্স অব কমার্স এবং বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের সাহায্য নিয়েছে। বেশ কিছু বড় সংস্থা এই সম্মেলনে হাজির থাকার কথা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে। তবে সংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে এখানকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলি। কেন? শিল্পোন্নয়ন নিগমের এক কর্তা জানাচ্ছেন, আসলে মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনতে যাঁরা আসবেন, তাঁদের বেশির ভাগই ইন্ডিয়া-সিঙ্গাপুর বণিকসভার সদস্য। এটি মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগীদের বণিকসভা। তবে সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় দু’টি সম্পদ ব্যবস্থাপনা তহবিল জিআইসি এবং টেমাসেক-এর কোনও প্রতিনিধি শিল্প সম্মেলনে থাকছেন না। জিআইসি-র আবাসন বিভাগের প্রধান-সহ সংস্থা কর্তাদের সঙ্গে অবশ্য এ দিনই বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুর সরকারের বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত নোডাল সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজেস’ (আইই)-এর প্রতিনিধিরা শিল্প সম্মেলনে হাজির থাকছেন বলে জানা গিয়েছে। সিঙ্গাপুরের কোনও সংস্থার বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করে আইই। মমতার সিঙ্গাপুর যাত্রাতেও বড় ভূমিকা নিয়েছে তারা।

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গাপুর বন্দর দেখতে যেতে পারেন। সেখান থেকে ফিরে এসে সফরসঙ্গী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন তিনি। চাঙ্গি বিমানবন্দর সংস্থার সঙ্গেও তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা। তার পর ওই সংস্থার দেওয়া নৈশভোজে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী।

সফরের প্রথম দিনে লগ্নি সম্ভাবনা নিয়ে কোনও সদর্থক আলোচনা হল কি? সরকারের এক মুখপাত্র জানাচ্ছেন, সোমবার জিআইসি-র কর্তাদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী অবশ্য এখনই এ প্রসঙ্গে কোনও কথা বলতে চান না। কলকাতা ছাড়ার আগেই তিনি বলেছিলেন, “এক সফরেই সব কিছু করে ফেলা সম্ভব নয়। এটা একটি ধারাবাহিক প্রয়াস।” সরকারি কর্তাদের একাংশও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে একমত। তাঁদের বক্তব্য, জ্যোতি বসু প্রতি বছর বিদেশ যেতেন। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীরও উচিত মাঝে মধ্যেই বিদেশে গিয়ে লগ্নি টানার এই প্রয়াস জারি রাখা।

মমতা অবশ্য আজ লগ্নি-বিনিয়োগ-শিল্পের ঘেরাটোপের বাইরেই থেকেছেন। সারা দিন বেশ খোশমেজাজেই ছিলেন তিনি। সকালে নেতাজি স্মারক দেখার পর জানালেন, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নেতাজি স্মারকের এলাকা আরও বড় আকারে বানিয়ে দেওয়ার আর্জি জানাবেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এখান থেকেই নেতাজি ‘দিল্লি চলো’র ডাক দিয়েছিলেন। আইএনএ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব। ওঁকে এই মেমোরিয়ালটা আরও একটু বড় করে দেওয়ার জন্য বলব।”

সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিল্প-বিনিয়োগ নিয়েও কথা হবে কি? শিল্প দফতরের এক কর্তা বলছেন, “সে তো হবেই। কিন্তু নেতাজির ব্যাপারটাও তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। সুভাষবাবুকে নিয়ে আর কে-ই বা বলবেন!” নেতাজি প্রসঙ্গের পাশাপাশি এখানকার জুরং পাখিরালয়ের ধাঁচে রাজারহাটে একটি পাখি-বিতান করার কথাও ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জুরং পাখিরালয় দেখে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “এখানে ২০ একর জমিতে তৈরি হয়েছে। কলকাতায় ৫ একর জমিতেও আমরা এ রকম পাখিরালয় বানাব।” শোনা যাচ্ছে, জুরং পাখিরালয়ের কর্ণধারকে কলকাতায় আমন্ত্রণ জানিয়ে এই কাজ করা হবে।

এ দিন যাতায়াতের পথে টুইন টাওয়ার্স সংলগ্ন এলাকায় মুখ্যমন্ত্রীর চোখে পড়ে নীল-সাদা বাড়ি! সঙ্গী এক সাংবাদিককে সকৌতুকে বলে ওঠেন, “এখানেও নীল-সাদা রং! কলকাতার নকলে কি!”

সিঙ্গুরের পাপ সিঙ্গাপুরে কাটবে কি, প্রশ্ন সূর্যের

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গাপুর সফর নিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষ এবং প্রশ্ন তোলা অব্যাহত। যে সিঙ্গুর আন্দোলনে সওয়ার হয়ে মমতা ক্ষমতার কাছে পৌঁছেছিলেন, তারই জেরে রাজ্য ছাড়তে হয়েছিল টাটার ন্যানো প্রকল্পকে। তখন শিল্প-বিরোধী তকমাও লেগেছিল মমতার গায়ে। মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফর প্রসঙ্গে সেই স্মৃতি উস্কে দিয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র সোমবার প্রশ্ন তুললেন, “আপনি কি ভাবছেন সিঙ্গাপুরে গিয়ে সিঙ্গুরের পাপস্খালন করবেন? সেটা হবে না।” পাশাপাশি, বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ জানালেন, মমতার সফরের খরচ কে দিল এবং ওই সফরে বঙ্গবাসীর কী লাভ হল, তথ্য জানার অধিকার আইনে তা জানতে চাইবে তারা। অন্য দিকে সূর্যবাবু বলেন, “এই সরকার সিঙ্গুরকে শ্মশানে পরিণত করেছে। তবু তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। আমি চাই দু’-একটা বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে অন্তত নিজেদের যাতায়াতের ভাড়া তুলে আনুন।” তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়, শাসক দলের নেতারা অবশ্য ফের বলেছেন বিরোধীরা অহেতুক কুৎসা করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সফরে কী লাভ হল, তা বুঝতে একটু অপেক্ষা করতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE