Advertisement
০৬ মে ২০২৪
আন্তর্জাতিক হাত দেখছে বন দফতর

মাদকচক্রেই কি যেত সাপের বিষ

কে জানে গরল কি না প্রকৃত পানীয়, অমৃতই বিষ!— এই সংশয়পীড়িত প্রশ্ন কবির মেধার ভিতরে শ্রান্তি বাড়িয়ে দিত।পানীয় হোক না-হোক, নৈহাটিতে বাজেয়াপ্ত করা সাপের বিষ যে খাস কলকাতার মাদকাসক্তদের জন্য সরবরাহ করা হচ্ছিল, সেই বিষয়ে তদন্তকারীদের সংশয়-সন্দেহ প্রায় নেই।

সাপের বিষ পাচারের অভিযোগে ধৃতেরা। — নিজস্ব চিত্র

সাপের বিষ পাচারের অভিযোগে ধৃতেরা। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:০৬
Share: Save:

কে জানে গরল কি না প্রকৃত পানীয়, অমৃতই বিষ!— এই সংশয়পীড়িত প্রশ্ন কবির মেধার ভিতরে শ্রান্তি বাড়িয়ে দিত।

পানীয় হোক না-হোক, নৈহাটিতে বাজেয়াপ্ত করা সাপের বিষ যে খাস কলকাতার মাদকাসক্তদের জন্য সরবরাহ করা হচ্ছিল, সেই বিষয়ে তদন্তকারীদের সংশয়-সন্দেহ প্রায় নেই। সাপের বিষ শুধু নানান ওষুধ তৈরিতে নয়, ব্যবহার করা হয় মাদক হিসেবেও। সেই সূত্রেই ওই বিষ পাচারকারীদের সঙ্গে মহানগরীর মাদক চক্রের যোগাযোগ স্পষ্ট হচ্ছে বনকর্তাদের কাছে। তাঁরা জানান, মাদকাসক্তদের চাহিদা মেটাতে চক্রের লোকজন নিয়মিত যোগাযোগ রাখে সাপের বিষের চোরাকারবারিদের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রেও রাখছিল।

মহানগরীর কোন কোন মাদক-ঠেকে ওই বিষ যেত, তদন্তকারীদের অনুসন্ধানের অন্যতম বিষয় সেটাই। সেই সঙ্গে ওই পাচারকারীদের পিছনে তাঁরা দেখছেন আন্তর্জাতিক মদতও। রাজ্যের বন্যপ্রাণ দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এর সঙ্গে বিশেষ করে ফ্রান্সের যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে।

ফ্রান্সে তৈরি বেলজিয়ান কাচের বয়ামে রাখা দানা দানা ওই মহার্ঘ গরল যেন ঠিক মিহি চিনি! মঙ্গলবার নৈহাটিতে হানা দিয়ে প্রায় দুই কিলোগ্রাম সাপের বিষ-সহ সাত জনকে পাকড়াও করে বন দফতর। বাজেয়াপ্ত করা হয় সাপের বিষ ভর্তি দু’টি বয়াম। বুধবার এক বনকর্তা বলেন, ‘‘মাদক হিসেবে ব্যবহারের জন্য ওই বিষও শহরের ‘রেভ পার্টি’ (মাদকাসক্তদের আখড়া)-তে সরবরাহ করার ছক ছিল বলে সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা। খাস কলকাতা বা শহরতলির ঠিক কোন কোন এলাকার মাদক পার্টিতে সাপের বিষ জোগান দেওয়ার কথা ছিল, তা যাচাই করা হচ্ছে।’’

সাপের বিষ পাচারের হার বেড়ে যাওয়ায় সর্পোদ্যান তৈরির অনুমতি দেওয়া আপাতত বন্ধ রেখেছে রাজ্যের বন দফতর। ধরপাকড়ের অভিযানেও জোর দেওয়া হচ্ছে। ওই দফতর সূত্রের খবর, বিশেষ কিছু ওষুধ তৈরিতে সাপের বিষ অন্যতম উপাদান। কিন্তু মাদক হিসেবে তার অপব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। নৈহাটিতে বিষের সঙ্গে বাজেয়াপ্ত করা একটি পুস্তিকায় সাপের বিষ মাদক হিসেবে ব্যবহার করার উপায়ও বাতলানো রয়েছে। তা থেকেই তদন্তকারীদের সন্দেহ, ওই বিষ কলকাতাতেই বিক্রির ছক ছিল। সেই খবর পেয়ে কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রকের ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরো এবং রাজ্যের বন আধিকারিকেরা ক্রেতা সেজে টোপ দিয়েছিলেন। আর সেই ফাঁদেই পা দেয় পাচারকারীরা। এই চক্রটি এর আগেও সাপের বিষ বিক্রি করেছে। কারা সেই বিষ কিনেছে, ধৃতদের জেরা করে তা জানার সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্রেতাদের কাছে পৌঁছতে চাইছে বন দফতর।

ধৃতদের জেরা করে বনকর্তারা জেনেছেন, এ রাজ্যেরই এক বাসিন্দা ওই বিষের বয়ামগুলি পাচার করতে দিয়েছিল অভিযুক্তদের। বুধবার রাত পর্যন্ত অবশ্য সেই পালের গোদাকে পাকড়াও করা যায়নি। ওই বিষ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে, নাকি এখানেই সাপ ধরে বিষ বার করা হয়েছিল— তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) প্রদীপ ব্যাস বলেন, ‘‘কিছু সূত্র মিলেছে। এই চক্রে যে বিভিন্ন স্তরের অনেক লোক জড়িত, সেটা স্পষ্ট। তারা কারা, সবিস্তার তদন্তে তা জানা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।’’

বন দফতরের খবর, নৈহাটিতে যে-ধরনের বয়ামে সাপের বিষ পাওয়া গিয়েছে, ঠিক তেমনই ছ’টি বয়াম ভর্তি সাপের বিষ গত বছর শিলিগুড়ি থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। সেই বিষ পাচার করা হচ্ছিল মায়ানমারে। রাজ্য বন্যপ্রাণ শাখার এক কর্তার মতে, পাচারের ক্ষেত্রে সাধারণত উত্তরবঙ্গ করিডরই ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা। দক্ষিণবঙ্গে সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। মঙ্গলবার ধৃত দেবব্রত বেরা, শেখ নাজেস আলি, রাজদীপ বসু, মানিক দাস, মিঠুন পাসোয়ান, সন্দীপ চক্রবর্তী ও দীপঙ্কর পালকে আদালতে তোলার পরে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে বন দফতর। জেরার মুখে ধৃতেরা তদন্তকারীদের জানায়, ওই বিষ ‘কোবরা’ গোত্রের সাপের। তবে সেই সাপ ঠিক কোন প্রজাতির, তা জানতে বিষের নমুনার ফরেন্সিক পরীক্ষা হচ্ছে। নৈহাটিতে বাজেয়াপ্ত করা বিষের বাজারদর আড়াই কোটি টাকারও বেশি বলে জানান বনকর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Forest Department Snake venom
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE