সোমবার ধর্মতলায় সভা। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা তৃণমূল কর্মীদের রাত কাটানোর ব্যবস্থা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। ছবি: শৌভিক দে।
তিনিই হেড দিদিমণি! তিনিই আবার ‘দুষ্টু’ ছাত্র-ছাত্রীদের স্নেহশীল দিদি!
ক্ষমতায় আসার কিছু আগে থেকেই নিয়ম করে দলীয় কর্মীদের আইন মেনে চলার নির্দেশ দিয়ে আসছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারবার বলেছেন, তৃণমূল কর্মী হলে তোলাবাজি করা চলবে না। যুক্ত থাকা যাবে না সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে। ৬ মাস আগে ব্রিগেডের সভা (পঞ্চায়েত ভোটের জন্য ২১ জুলাইয়ের সভা পিছিয়ে ওই সময়েই হয়েছিল) থেকেও একই বার্তা দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু হেড দিদিমণির এই কড়া বার্তা বিফলেই যাচ্ছে স্নেহশীল দিদির প্রশ্রয়ে! রায়গঞ্জে কলেজ অধ্যক্ষের উপরে হামলা থেকে শুরু করে আরাবুল শেখ, অনুব্রত মণ্ডল, মনিরুল ইসলাম, ঊষারানি মণ্ডল বা দীপালি সাহা, তাপস পাল হয়ে শ্যাম গোষ্ঠী সব ক্ষেত্রেই হয় সাজানো ঘটনা, না হয় ছোট ঘটনা বলে অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন মমতা। আর খোদ মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি লঘু করে দেওয়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই এগোনোর সাহস দেখায়নি পুলিশ-প্রশাসন।
তৃণমূলের অন্দরের জল্পনা, আজ, সোমবার ধর্মতলায় শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে আরও এক বার হয়তো দলে শৃঙ্খলা রক্ষা করার কথা বলবেন মমতা। বলবেন গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বন্ধ করার কথা। নিষেধ করবেন তোলাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে জড়াতে। কিন্তু বাস্তবে সে সব কথার কথা হিসেবেই থেকে যাবে। কারণ, এই সব কাজে অভিযুক্ত কোনও তৃণমূল কর্মীর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নজির সাম্প্রতিক অতীতে নেই।
ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে ৬ মাস আগেই তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন, উন্নততর বাংলা গড়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, শৃঙ্খলাপরায়ণ, নিবেদিত যুব সমাজকে তাঁর দরকার। ডিটারমিনেশন, ডিসিপ্লিন, ডেডিকেশন এবং ডিভোশন এই চার ‘ডি’ তাঁর প্রিয় মন্ত্র। কিন্তু সেই ব্রিগেডের মঞ্চে সেই তৃণমূল নেত্রীকেই হাল্কা সুরে বলতে শোনা গিয়েছিল, “দামাল ছেলেরা একটু দুষ্টুমি করবেই! এটা ওদের ধর্ম!” মঞ্চে সে দিন বসেছিলেন অনুব্রত মণ্ডল, মনিরুল ইসলামেরা। নেত্রীর মুখে দামাল ছেলেদের দুষ্টুমির কথা শুনে আতঙ্কিত হয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতারা। দুর্গাপুরের যুব শিবিরেও চার ‘ডি’র কথা বলেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। আবার সেখানেই বলেছিলেন, বীরভূমের জেলা সভাপতি অনুব্রত দক্ষ সংগঠক। কেউ কেউ তার পিছনে লাগছে!
এর পর তাপস পালের ‘দলের ছেলে দিয়ে রেপ করানোর’ হুমকিকেও ছোট ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কৃষ্ণনগরের সাংসদের ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠিই যথেষ্ট বলে জানিয়ে বলেছেন, “আমি ওকে কী করব! আই কিল হিম?” আর অতি সম্প্রতি জামুড়িয়ায় শ্যাম গোষ্ঠীর কাছ থেকে তৃণমূল নেতাদের তোলাবাজি এবং সংস্থার কর্তাদের হুমকি দেওয়ার ঘটনাকেও ছোট ঘটনা এবং সংবাদমাধ্যমের বাড়াবাড়ি বলে আখ্যা দিয়েছেন মমতা।
২১ জুলাই শহিদ বেদি তৈরির কাজ চলছে বিড়লা তারামণ্ডলের সামনে।
আজ, সোমবার উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: সুদীপ আচার্য।
দলনেত্রীকে লাগাতার এমন ভূমিকায় দেখতে দেখতে তাই তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে প্রশ্ন উঠছে, মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি কি কেবলই কথার কথা? প্রতি বার দলের কোনও বড় মঞ্চ থেকে তিনি নিয়মমাফিক কিছু সতর্ক-বার্তা জারি করবেন। আবার সেই সতর্ক-বার্তা না মানা অভিযুক্তদের নিজেই আড়াল করবেন! তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় যদিও বলছেন, “দলের পতাকা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। দলের পতাকা নিয়ে যাঁরা নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি করতে চাইছেন, তাঁদের কোনও স্থান তৃণমূলে নেই। এটাই দলের ঘোষিত নীতি।” কিন্তু দলের অন্দরে অনেকেই বলছেন, মনোভাবের বদল না হলে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অবস্থা পাল্টাবে না এতটুকুও। শাসক দলের এক সাংসদের কথায়, “আমাদের দলে খারাপ লোকের সংখ্যা কম। কিন্তু মাত্র ১% পচা আপেলও ঝুড়িতে থাকলে সব আপেল নষ্ট হয়। ওই ১%-কে চিহ্নিত করে ঝুড়ির বাইরে ফেলতে হবে।”
আর বিরোধীরা কী বলছেন?
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, “গৃহস্থকে বলবেন সতর্ক থাকো। চোরকে বলবেন চুরি করো! এটাই তো এখন ওঁর নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে! এমন ভাবে বলবেন, সবাইকে সব সঙ্কেত দেওয়া থাকবে!” বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মতে, “রঘু ডাকাতকে সরিয়ে কালু ডাকাত এসেছে! রাজ্যের মানুষ এটা এত দিনে বুঝে গিয়েছে। বাম আমলের সব বদরক্ত এখনই তৃণমূলে জমা হয়ে গিয়েছে। নিয়ন্ত্রণের কোনও লক্ষণ আছে কোথাও?”
তৃণমূলের বহু নেতার ধারণা, দলের একটা অংশ বেলাগাম হয়ে পড়েছে বলেই এ রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্তের পথ সহজ হচ্ছে। তাঁদের মতে, আগামী বছরের পুরভোট এবং তার পরের বছরের বিধানসভা ভোটকে মাথায় রেখে বিজেপির বিপদ মোকাবিলার কথা আজ বলতে পারেন মমতা। কিন্তু সেটা কার্যকর করতে গেলে দলীয় নেতা-কর্মীদের আচরণই আগে শোধরানো দরকার। তৃণমূলের এক যুব নেতার কথায়, “রাজ্যের উন্নয়নের জন্য দিদি বহু পরিশ্রম করছেন। কিন্তু দলটার সর্বস্তরে এমন সব লোক ছড়ি ঘোরাচ্ছে, যাদের এখনই সামলাতে না পারলে সামনে বড় বিপদ!”
তৃণমূলের একটি সূত্র বলছে, আগামী বছরের পুরভোটের আগে আজকের মতো এত বড় মঞ্চ মমতা আর পাবেন কি না, ঠিক নেই। তাই বার্তা দিতে হবে আজই। দলের গোষ্ঠী-বিবাদ নিয়ন্ত্রণে আসবে কী ভাবে, জানতে চায় তৃণমূল-সহ সংশ্লিষ্ট সকলে। তৃণমূল সম্পর্কে সাধারণ ধারণা বদলানোর কোনও পথ খুলবে কি না, সেই প্রশ্নও আছে সর্বত্র। শিল্প মহল জানতে চায়, ঠিক কী করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। সোজা কথায়, আজ এক ঢিলে বহু পাখিকে নিশানা করতে হবে ধর্মতলার মঞ্চ থেকে। তৃণমূলের অন্দরেও প্রত্যাশা তেমনই।
স্বয়ং মমতা রবিবার অবশ্য উল্লেখ করেছেন শুধু একুশের আবেগকে। ফেসবুকে লিখেছেন, ‘২১শে জুলাই-এর আন্দোলন আজীবন আমার স্মৃতির সরণিতে থাকবে সযত্নে। ২১শে দিনটা সব আন্দোলনের, সমস্ত শহিদকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন’। তাঁর আহ্বান, ‘২১শে জুলাইয়ের আন্দোলন এ বার ২১ বছর পূর্ণ করল। আসুন, সবাই মিলে মিলিত হই’।
বিরোধীরা বলছেন, এ বার একুশের কোনও নির্দিষ্ট কোনও স্লোগান (সে বাম-বিরোধী, কেন্দ্র-বিরোধী যেমনই হোক) তৃণমূলের হোর্ডিংয়ে-পোস্টারে নেই। শুধুই ‘দিদির ডাক’। সে বিরোধীরা যা-ই বলুন, ‘দিদির ডাকে’ সাড়া দিয়েই কলকাতা যে আজ উপচে পড়বে, সেটা ধরে নেওয়া যায়।
তবে দামাল ছেলেদের দুষ্টুমি বন্ধের কোনও দাওয়াই সে ভিড়ের জন্য থাকবে কি? কোটি টাকার প্রশ্ন সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy