Advertisement
E-Paper

অভিযোগ সার, রাস্তা আটকে সিন্ডিকেট জটে

সিন্ডিকেট করতে চাইলে, তৃণমূল ছাড়তে হবে— একুশে জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে নিজেই এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু হাওড়ার এক ঠিকাদার সংস্থার অভিজ্ঞতা বলছে, মুখ্যমন্ত্রীর দলের লোকের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট চালানোর অভিযোগ করেও কোনও লাভ হচ্ছে না!

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩২
খয়রাশোলে ঠিকাদার সংস্থার তৈরি ‘ইট প্লান্ট’।—নিজস্ব চিত্র।

খয়রাশোলে ঠিকাদার সংস্থার তৈরি ‘ইট প্লান্ট’।—নিজস্ব চিত্র।

সিন্ডিকেট করতে চাইলে, তৃণমূল ছাড়তে হবে— একুশে জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে নিজেই এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু হাওড়ার এক ঠিকাদার সংস্থার অভিজ্ঞতা বলছে, মুখ্যমন্ত্রীর দলের লোকের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট চালানোর অভিযোগ করেও কোনও লাভ হচ্ছে না! বীরভূমের জেলাশাসকের কাছে গত মাসে অভিযোগ করার পরেও শুক্রবার পর্যন্ত প্রশাসনিক কোনও সাহায্য মেলেনি বলে ওই ঠিকাদার সংস্থার দাবি।

ওই সংস্থা বীরভূমে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা সংস্কারের দায়িত্ব পেয়েছিল। তার একটি হল, দুবরাজপুর থেকে কুখুটিয়া হয়ে সারিবাগান পর্যন্ত ৫.৬ কিলোমিটার রাস্তা। যার সংস্কারের জন্য পূর্ত দফতর বরাদ্দ করেছে সওয়া ৫ কোটি টাকা। কিন্তু সংস্থার অভিযোগ, তৃণমূলের নেতাদের সিন্ডিকেটের জুলুমে রাস্তার কাজ শুরুই করা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে ঠিকাদার সংস্থার কর্তৃপক্ষ জেলাশাসককে লেখা চিঠিতে জানতে চেয়েছেন, ‘‘আপনার কাছে প্রশ্ন, আমাদের কি কিছুই করার নেই, না প্রশাসনের কাছ থেকে কিছু সাহায্য পেতে পারি?’’ গত ১২ জুন জেলাশাসকের কাছে ওই চিঠি পাঠানো হলেও এখনও অবধি কাজের কাজ কিছু হয়নি। সংবাদমাধ্যমের তরফে জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী এবং পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারকে ফোন করা হলে তাঁরা ফোন ধরেননি। এসএমএস-এরও জবাব দেননি।

আর তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল সটান বলে দিয়েছেন, ‘‘ওই সব এলাকায় কোনও সিন্ডিকেট নেই। দলের কেউ তাতে যুক্তও নন।’’

তৃণমূলের কিছু নেতার মদতে ইমারতি ব্যবসার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে এর আগে নিউটাউন, রাজারহাটের মতো এলাকায় বারবার গণ্ডগোল বেধেছে। ঘটেছে প্রাণহানিও। আর এই সব ঘটনায় শাসক দলের দিকেই আঙুল উঠেছে। দলেরই একটা বড় অংশের মত হল, দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বুঝেই ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, ‘‘কেউ যদি সিন্ডিকেট করতে চান, সিন্ডিকেট করুন। তৃণমূল করবেন না।’’ কিন্তু বিরোধীদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী মৌখিক হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বটে, কিন্তু অভিযুক্তদের সঙ্গে দলের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার রাস্তাটি দেখাননি! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘সিন্ডিকেট করার অপরাধে মুখ্যমন্ত্রী কাউকে দল থেকে তাড়িয়ে দেখিয়েছেন কি? কোন ধরনের অপরাধ করলে, কী ভাবে দল থেকে বার করে দেওয়া হবে, সে সবও বলেননি। তাই ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে— মুখ্যমন্ত্রী যা বলবেন, তার উল্টোটা ঘটবে!’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘তৃণমূল আর সিন্ডিকেট সমার্থক! শাসক দলের দাপটে সিন্ডিকেটের জন্য যদি রাস্তা বা উন্নয়নের কাজ বন্ধও হয়ে যায়, কারও কিছু যায় আসে না!’’

ঠিকাদার সংস্থার দাবি, দুবরাজপুরের রাস্তা নিয়ে সমস্যা মেটাতে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠক হয়েছে। তবে সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি। কেন? ঠিকাদার সংস্থার এক কর্তার কথায়, ‘‘৬ জুলাই বৈঠকে গিয়ে দেখি, সিন্ডিকেট নিয়ে যাঁদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ, দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির সেই সদস্য ছবিলাল দাস, তৃণমূল কর্মী শেখ নলাখ, শেখ শফিকদের নিয়েই হাজির হয়েছেন দুবরাজপুর ব্লক সভাপতি ভোলা মিত্র। সিন্ডিকেটের হয়েই কথা বলছিলেন তিনি। জানতে চাইছিলেন সিন্ডিকেটকে টাকা দেওয়ার চলতি প্রথা না জেনে, কী ভাবে টেন্ডারে যোগ দিলাম আমরা।’’ এ ব্যাপারে ভোলাবাবুর বক্তব্য কী? তাঁর দাবি, ‘‘ওই ঠিকাদার সংস্থা কেন আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করছে, বুঝতে পারছি না। আমার কাছে ওঁদের ফোন নম্বর পর্যন্ত নেই!’’ রাস্তার কাজে বারবার বাধা দিচ্ছেন বলে যাঁর বিরুদ্ধে সংস্থার অভিযোগ, সেই তৃণমূল কর্মী শেখ শফিক কিন্তু দাবি করেছেন, ‘‘ভোলাদার নেতৃত্বেই আমরা সব করেছি। রাস্তা তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ করার যে দর দিয়েছিলাম, তাতে সংস্থা রাজি হয়নি। তখন বলেছিলাম, কোনও ঝামেলা যাতে না হয়, সেটা আমরাই দেখব। তার বদলে যে ছেলেরা খাটবে, ওঁদের কিছু দেবেন। ভয় দেখিয়ে নয়, এটা আমাদের আবদার ছিল।’’

এর পরে কি ভোলাবাবুদের দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে? তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলছেন, ‘‘প্রশ্নই নেই। ওই ঠিকাদার সংস্থার প্রয়োজনীয় যন্ত্র নেই। তাই কাজ করতে পারেনি। বর্ষার মুখে দেরি হয়ে যাওয়ায় এখন সিন্ডিকেটের ধুয়ো তুলছে।’’ অনুব্রতর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ঠিকদার সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ বলছেন, ‘‘আমাদের তরফ থেকে সব কিছু করা হলেও স্থানীয় সিন্ডিকেটের চাপে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে এই মূহূর্তে আমাদের পক্ষে আর দুবরাজপুরের রাস্তার কাজে হাত দেওয়া সম্ভব নয়।’’

ঠিকাদার সংস্থা যে মিথ্যা বলছে না, সে কথা মানছেন জেলা পূর্ত দফতরের (সড়ক বিভাগ) এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার আসফার আলিও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ঠিকাদার তৈরি ছিলেন। এত দিনে রাস্তার কাজ শুরু হয়ে যেত। কিন্তু এক দল লোক অন্যায় দাবি করছে। ঠিকাদারকে নিরুপদ্রব সাইট (কাজের জায়গা) দিতে না পারলে, তিনি-ই বা কী ভাবে কাজ করবেন! জেলা প্রশাসনের মধ্যস্থতায় সমস্যা মেটানোর চেষ্টা হচ্ছে।’’

এই সংস্থাই রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক সংযোগকারী পাঁচড়া মোড় থেকে খয়রাশোল পর্যন্ত ৮.৬ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কারের জন্যও প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছিল। সেখানেও সিন্ডিকেটের চাপ এসেছিল বলে অভিযোগ। এমনকী সংস্থার অস্থায়ী কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর চালানোর দায়ে চার তৃণমূল কর্মীর নামে পুলিশে অভিযোগও দায়ের হয়। পুলিশ তেমন কিছু না করলেও শেষমেশ তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে বসেই এ মাসের গোড়ায় সমস্যা মিটিয়েছে ওই সংস্থা। তাদের বক্তব্য, খয়রাশোল থেকে নির্বাচিত জেলা পরিষদের তৃণমূল কর্মাধ্যক্ষ নবগোপাল বাউড়ি, তৃণমূলের খয়রাশোল ব্লক সভাপতি সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়দের ‘মধ্যস্থতা’য় পাঁচড়া-খয়রাশোল রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে ছাড়পত্র মিলেছে। সেখানে সিন্ডিকেটের চাপ আর নেই। কিন্তু দুবরাজপুরের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। এবং স্থানীয় সূত্রের খবর হল, খয়রাশোলের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ‘গুনাগার’ দিয়েই রফাসূত্রে আসতে পেরেছে ঠিকাদার সংস্থাটি। রাস্তার কাজ যদিও এখনও শুরু হয়নি।

বীরভূমের জেলা সভাধিপতি তথা তৃণমূল নেতা বিকাশ রায়চৌধুরী অবশ্য সব শুনে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ‘‘যত বড় মস্তানই হোক, উন্নয়নের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ালে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’’

তা হলে জেলা প্রশাসন এখনও ব্যবস্থা নিল না কেন, কেনই বা নিষ্ক্রিয় পুলিশ? নাম না জানানোর শর্তে জেলা প্রশাসন এবং পুলিশের একাধিক কর্তা বলেছেন, ‘‘শাসক দল বলে কথা! বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?’’

সিন্ডিকেট সমস্যা নিয়ে পূর্ণেন্দু

ইট-বালি-সহ ইমারতি দ্রব্যের সিন্ডিকেট নিয়ে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব বহুদিনের। সেই দ্বন্দ্ব থেকে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেন রাজারহাট-গোপালপুরের বিধায়ক তথা কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। বারাসতে এক অনুষ্ঠানের পর পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, ‘‘আমার এলাকায় সিন্ডিকেটের সমস্যা নেই। সিন্ডিকেট নিউটাউনে রয়েছে। ওখানকার বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত।’’ সব্যসাচীবাবুর কথায়, ‘‘উনি (পূর্ণেন্দু) আমার পিতৃতুল্য। আমাদের আজও কথা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম ওঁর বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করেছে।’’ রাজারহাট-নিউটাইনে সিন্ডিকেট নিয়ে তৃণমূলের নেতা, বিধায়ক, সাংসদদের বিবাদে পূর্ণেন্দু-সব্যসাচীর এ দিনের মন্তব্য নতুন মাত্রা যোগ করল বলে রাজনীতিকদের একাংশের অভিমত। তবে তৃণমূল শিবিরেরই অন্য অংশের বক্তব্য, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০১১ সালে সিন্ডিকেট-বিবাদে প্রথম মৃত্যু হয় কেষ্টপুরে। যা পূর্ণেন্দুবাবুর বিধানসভার মধ্যে পড়ে।

dayal sengupta syndicate problem important roads birbhum syndicate birbhum tmc dubrajpur road panagarh moregram highway road repairing road building 60 no national highway panchra khayrasole
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy