Advertisement
E-Paper

উপাচার্যের ডাকে এসে পুলিশি তাণ্ডব যাদবপুরে

কোলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে ভিতরে মোতায়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীরা। উপাচার্য রয়েছেন আরও ভিতরে, মিটিং রুমে। আন্দোলনরত পড়ুয়াদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হঠাৎই বিপন্ন বোধ করলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। সুতরাং ডেকে পাঠালেন পুলিশকে। উপাচার্যের ‘প্রাণ বাঁচাতে’ মঙ্গলবার গভীর রাতে ছাত্রছাত্রীদের বেধড়ক মারধর করে হটিয়ে দিল পুলিশবাহিনী। উপাচার্য বললেন, “আমি পুলিশের কাছে কৃতজ্ঞ।”

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৫৪

কোলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে ভিতরে মোতায়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীরা। উপাচার্য রয়েছেন আরও ভিতরে, মিটিং রুমে। আন্দোলনরত পড়ুয়াদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হঠাৎই বিপন্ন বোধ করলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। সুতরাং ডেকে পাঠালেন পুলিশকে। উপাচার্যের ‘প্রাণ বাঁচাতে’ মঙ্গলবার গভীর রাতে ছাত্রছাত্রীদের বেধড়ক মারধর করে হটিয়ে দিল পুলিশবাহিনী। উপাচার্য বললেন, “আমি পুলিশের কাছে কৃতজ্ঞ।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে নিগ্রহের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি এবং অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টার প্রতিবাদে মঙ্গলবার দুপুর থেকে উপাচার্যের দফতর অরবিন্দ ভবনের বাইরে অবস্থান শুরু করেন ছাত্রছাত্রীরা। রাত বাড়তে সেই ধর্না ঘেরাওয়ের আকার নেয়। রাত আটটা নাগাদ পুলিশ তলব করেন উপাচার্য। যাদবপুর থানা থেকে পুলিশ এলেও গোড়ায় তারা হস্তক্ষেপ করেনি। রাত পৌনে ৯টা নাগাদ ঘেরাও তুলে নেওয়ার জন্য উপাচার্য ১৫ মিনিট সময় দেন। জানিয়ে দেন, অন্যথায় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। ইতিমধ্যে ঘেরাওকারীর সংখ্যা বাড়ে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও যোগ দেন। ব্যর্থ হয় কিছু শিক্ষকের মধ্যস্থতার চেষ্টা।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

রাত দু’টো নাগাদ নিজের জীবন বিপন্ন দাবি করে প্রশাসনের উপর মহলে বার্তা পাঠান উপাচার্য। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বুধবার বলেন, “মঙ্গলবার রাতেই উপাচার্যের সঙ্গে কথা হয়। উনি জানান, খুন হয়ে যেতে পারতেন ছাত্রছাত্রীদের হাতে।” কিন্তু কেন উপাচার্যের মনে এমন আশঙ্কার জন্ম হল, তার কোনও ব্যাখ্যা এ দিন মেলেনি। তবে সেই বার্তা পেয়েই পুলিশ আসরে নেমে পড়ে। আচমকা আলো নিভে যায় প্রশাসনিক ভবনের। ছাত্রছাত্রীদের মেরেধরে সরিয়ে উপাচার্যকে ‘উদ্ধার’ করে পুলিশ।

বুধবার সকালে বিধাননগরের এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসেন উপাচার্য। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বলেন, “রাত দু’টোর সময়ে পুলিশ যখন আমাকে মুক্ত করতে যায়, তখন ছাত্রছাত্রীদের যে উন্মত্ত তাণ্ডব দেখেছি, তা ভুলব না। পুলিশ ওদের মারেনি। ছাত্ররাই পুলিশকে মেরেছে। আমার নিরাপত্তারক্ষীকেও মেরে ওরা আমাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করে।”

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

উপাচার্য জানান, বাইরে থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা এসে আন্দোলন জোরদার করবে বলে তাঁর কাছে খবর ছিল। তিনি বলেন, “আন্দোলনকারীরা আমার চামড়া চায় বলে স্লোগান দিচ্ছিল। একটা সময়ের পরে আমরা অসুস্থ বোধ করতে শুরু করি। তখন বাধ্য হয়ে পুলিশকে বলি আমাদের মুক্ত করতে। কোনও সুস্থ দেশে শিক্ষকদের উপরে বর্বরোচিত আক্রমণ হবে ভাবতে পারিনি।”

তৃণমূল আমলে যাদবপুরের তুলনায় বড় মাপের ঘটনা এ রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে বহু বার ঘটেছে। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যক্ষকে মারধর, ভাঙড় কলেজে শিক্ষিকাকে জগ ছুড়ে মারা, জয়পুরিয়া কলেজের অধ্যক্ষের উপরে চড়াও হওয়া প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাঠগড়ায় হয় তৃণমূল নেতা, না হয় তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)। আর সব ক্ষেত্রে কখনও ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভুল’, কখনও ‘দু’একটি খারাপ ঘটনা’ বলে অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তা হলে যাদবপুরে লোহার গেটের ও-পারে বন্ধ দরজার আড়ালে বসে থাকা উপাচার্যকে ছাত্রছাত্রীদের হাত থেকে বাঁচাতে পুলিশকে মারমুখী হতে হল কেন? পার্থবাবুর জবাব, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি অস্ত্র নিয়ে দাঙ্গাবাজি করে, আর কর্তৃপক্ষ জানান যে, তাঁরা খুন হয়ে যেতে পারেন, তা হলে কি প্রশাসন হস্তক্ষেপ করবে না? ছাত্রছাত্রীদের অনেক বার আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য বোঝানো হয়েছে। কিন্তু তারা শোনেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তো রাজনীতির আখড়া করতে দেওয়া যায় না!”

কিন্তু আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা কি সত্যিই সশস্ত্র ছিল? পুলিশ কিন্তু এ রকম কোনও অভিযোগ করেনি। উল্টে জখম হয়েছেন ১২ জন ছাত্র। সঙ্গী পড়ুয়ারাই তাঁদের পাশের কেপিসি হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হলেও দু’জনকে ভর্তি করতে হয়। আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের অভিযোগ, পুলিশ তাঁদের উপরে নির্বিচারে লাঠি চালিয়েছে। অভিযোগ অস্বীকার করে কলকাতার যুগ্ম কমিশনার (প্রশাসন) মেহবুব রহমান জানিয়েছেন, পুলিশের সঙ্গে লাঠি ছিলই না। তবে বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রছাত্রীদের কারও হাত ভেঙেছে, কারও পায়ে আঘাত। কারও চোখের তলায় কালসিটে, গলায় গুরুতর চোট। ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরিয়েছে অনেকের।

যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রের অবশ্য দাবি, উপাচার্যকে উদ্ধার করতে গিয়েও ১১ জন পুলিশ জখম হয়েছেন। তিনি বলেন, “উপাচার্য আমাদের ফোনে জানান, তিনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। তাঁর প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা রয়েছে। উদ্ধারের জন্য তিনি আমাদের কাছে আর্জি জানান।” রাত আটটা নাগাদ ঘটনাস্থলে পুলিশ বাহিনী পৌঁছয়। রাত দু’টো পর্যন্ত পুলিশ সকলকে বুঝিয়ে আন্দোলন তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই চেষ্টায় কোনও সাড়া না-মেলাতেই পুলিশকে বলপ্রয়োগ করতে হয় বলে দাবি ওই কর্তার।

আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্য, তাঁরা হাততালি দিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। রাত দু’টো নাগাদ পুলিশের বিশাল বাহিনী আসে। সঙ্গে বেশ কিছু বহিরাগত। তাদের অনেকেই তৃণমূল কর্মী বলে আন্দোলনকারীদের দাবি। পুলিশের অবশ্য বক্তব্য, বহিরাগত কেউ তাদের সঙ্গে ক্যাম্পাসে ঢোকেনি। তবে উর্দিধারী বাহিনীর সঙ্গে সাদা পোশাকের পুলিশও ছিল। যাদের বেশির ভাগই গেঞ্জি পরা।

ছাত্রদের অভিযোগ, উর্দিধারী আর গেঞ্জি-পুলিশ মিলে তাদের সরিয়ে দিতে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। সেই সময় আচমকা প্রশাসনিক ভবনের আলো নিভে যায়। অন্ধকারে শুরু হয় মারধর। সঙ্গে এলোপাথাড়ি কিল-চড়-ঘুষি। ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির অভিযোগও উঠেছে। উপাচার্য, যাদবপুর থানার ওসি এবং পুলিশের এক এসিপি-র বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন এক দল ছাত্রী। পুলিশি তাণ্ডবের রেশ কিছুটা কাটতে মঙ্গলবার রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল ছাত্রছাত্রী যাদবপুর থানার মোড়ে পথ অবরোধ করেন। মারধরের মধ্যেই উপাচার্য, রেজিস্ট্রার-সহ অন্য কর্তা, আধিকারিক, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিরাপদে বার করে নিয়ে যায় পুলিশ।

আলো নেভাল কে? এই প্রশ্নের উত্তরে উপাচার্য জানিয়েছে, ছাত্রেরাই আলো ভেঙে দিয়েছেন। ছাত্রদের বক্তব্য, প্রশাসনিক ভবনের আলোর সুইচ তো বন্ধ কোলাপসিবল গেটের ভিতরে। পরিকল্পিত ভাবে আলো নিভিয়েই পুলিশ মারধর শুরু করে। বুধবার এক ছাত্রী বলেন, “পুলিশ আসছে শুনে মেয়েরা ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎই ওরা ধাক্কা মেরে আমাদের ফেলে দেয়। এলোপাথাড়ি মারতে থাকে, শ্লীলতাহানি করে, জামাকাপড় ছিঁড়ে দেয়।” যাঁরা মাটিতে পড়ে যান, তাঁদের উপর দিয়েই চলে দৌড়োদৌড়ি, মারামারি। চুলের মুঠি ধরে এক ছাত্রীকে পুলিশি ভ্যানে উঠিয়ে লালবাজারে আনা হয়। পরে বাঙুর হাসপাতালে শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে তাঁকে বসিয়ে রাখা হয় যাদবপুর থানায়। গ্রেফতার করা হয় ৩৬ জন ছাত্রকে। কারও কারও বিরুদ্ধে জামিনঅযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করার চেষ্টা হয় বলেও অভিযোগ। বুধবার দুপুরে মুক্ত হন গ্রেফতার হওয়া পড়ুয়ারা।

পুলিশি নিগ্রহের প্রতিবাদে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করে বুধবার মিছিল করেন যাদবপুরের অনেক ছাত্রছাত্রী। শিক্ষক-শিক্ষিকা-সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সামিল হন সেই মিছিলে। এ দিন সন্ধ্যায় আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন যাদবপুরের শিক্ষক সংগঠন ‘জুটা’র এক প্রতিনিধি দল। জুটা-র বক্তব্য, এই ঘটনার পরে অভিজিৎবাবুর আর উপাচার্য পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। উপাচার্য অবশ্য জানিয়েছেন, পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। যদিও এ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় কাউকেই পাশে পাননি তিনি। পুলিশ ডেকে ঘেরাও মুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত যে একেবারেই উপাচার্যের নিজস্ব, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যাদবপুরের এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিলের (ইসি) অনেক সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়েরও কোনও কোনও কর্তা। আজ, বৃহস্পতিবার থেকে অনির্দিষ্ট কাল ক্লাস বয়কটের ডাক দিয়েছেন যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা। আজ, বৃহস্পতিবার ছাত্র ধর্মঘট ডেকেছে এসএফআই।

পাশাপাশি, গত ২৮ অগস্ট এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ থেকে শুরু করে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত যা ঘটেছে, সে সম্পর্কে উপাচার্যের কাছে রিপোর্ট চেয়েছেন মন্ত্রী।

ছাত্রছাত্রীদের হাতে কর্তৃপক্ষের ঘেরাও হওয়া এ রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষত যাদবপুরে মোটেই নতুন নয়। গত বছরই ৪৯ ঘণ্টা ঘেরাও করা হয়েছিল উপাচার্য-রেজিস্ট্রারকে। ২০০৭-এ ঘেরাও চলে ৫২ ঘণ্টা। কিন্তু কখনওই ঘেরাওমুক্ত হতে পুলিশি সাহায্য দরকার হয়নি।

এ বার অন্য পথে হাঁটলেন উপাচার্য।

jadavpur university vice chancellor clash molestation kolkata news online news latest news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy