ভাসানের চেনা ছবি — ফাইল চিত্র।
কালীপুজো, দিওয়ালিকে টেক্কা দিল ভাইফোঁটার রাত! মঙ্গলবার কালীপ্রতিমা ভাসানের শেষ প্রহরে শব্দদানব দাপিয়ে ঘুরল শহর জুড়ে। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম।
আর তার চোখরাঙানির সামনে কুঁকড়ে রইল আমজনতা। এমনকী বহু ক্ষেত্রে পুলিশও। অনেক জায়গায় আইনরক্ষকদের নাকের ডগাতেই ভাসানের মিছিল থেকে পিলে চমকানো শব্দে দেদার বাজি ফেটেছে। কান ঝালাপালা করেছে ডিজে। এক-এক জায়গায় মিছিল থামিয়ে শব্দবাজি ও ডিজে সহকারে একটানা তুমুল নৃত্য বাসিন্দাদের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়েছে। দরজা-জানালা বন্ধ করেও নিস্তার মেলেনি।
যেমন দেখা গেল বাগবাজারে, রাত সাড়ে দশটায়। বাগবাজার স্ট্রিটের একপাশ বন্ধ। বিসর্জনমুখী প্রতিমার লম্বা লাইন। প্রায় সব ট্রাকে ডিজে বাজছে। পাল্লা দিয়ে ফাটছে শব্দবাজি। পাশের লোকের কথাও শোনা যাচ্ছে না। রাত একটা নাগাদ টালার দত্তবাগান, মিল্ক কলোনি হয়ে ভাসান-মিছিলের স্রোত যখন পাইকপাড়ায়, শব্দের বহর রীতিমতো কাঁপুনি ধরানো। বড় রাস্তার পাশে সর্বাণী দত্তের বাড়ি। দুর্বিষহ সেই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বুধবার তিনি বলেন, ‘‘আওয়াজের চোটে ঘুম ভেঙে গেল। তিষ্ঠোতে পারছিলাম না। অসুস্থ শ্বশুরমশাইকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। তড়িঘড়ি উঠে সব জানলা বন্ধ করলাম। তাতেও যে-কে-সে-ই।’’
দক্ষিণও পিছিয়ে নেই। রাত এগারোটার পরে চেতলার পিয়ারিমোহন রায় রোড ধরে পরের পর বিসর্জনের মিছিল গিয়েছে, তারস্বরে বক্স বাজাতে বাজাতে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ থাকতেও কেউ পরোয়া করেনি। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ গড়ফা মেন রোডে গাড়ি নিয়ে আটকে পড়েছিলেন সুদীপ মৈত্র। রাস্তা জুড়ে ভাসানের লরি। বাজি-ডিজে’র দৌরাত্ম্যে কান পাতা দায়। সেই কষ্ট সহ্য করে কুড়ি মিনিটের পথ পেরোতে লাগল পৌনে এক ঘণ্টা।
কালীপুজো, দীপাবলিতে পুলিশ-প্রশাসনের তৎপরতায় কিছুটা কোণঠাসা থাকলেও বিসর্জনের রাতে ‘শব্দাসুর’ এ ভাবেই বোতলের ছিপি খুলে বেরিয়ে এসেছে। মঙ্গলবার রাতে ফুলবাগান থানার নারকেলডাঙা মেন রোডে শব্দবাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে চার জন মার খেয়েছেন। ঘটনা হল, প্রকাশ্যে ডিজে নিষিদ্ধ করে ২০১০-এ রাজ্য পরিবেশ দফতর যে বিধি বানিয়েছে, তা কার্যকর করার দায়িত্ব রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পুলিশের। অথচ বিসর্জনের দু’রাতে (সোম ও মঙ্গলবার) পুলিশ সে ভাবে গা নাড়ায়নি বলে পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ। পাশাপাশি রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ভূমিকার দিকেও আঙুল উঠছে। ‘‘আগে পর্ষদের তরফে যে রকম সক্রিয়তা দেখা যেত, এখন তার ছিঁটেফোঁটা নেই!’’— আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে পরিবেশকর্মী মহলে। কী রকম?
পর্ষদ সূত্রে খবর: রাত দশটার পরে জলসা, কিংবা তারস্বরে মাইক বাজিয়ে ভাসানের মিছিল চলাকালীন পর্ষদের অফিসারেরা গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন— হাতের কাছে এমন নজির বেশ কিছু মজুত। যেমন ২০০৫-এ চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর জলসা রুখে দিয়েছিলেন পর্ষদের আধিকারিকেরা। অভিযুক্ত পুজো কমিটিকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছিল। ২০০৬-এ আলিপুরে পুলিশ হাসপাতালের পাশে রাতদুপুরে কালীপুজোর ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ও পর্ষদ বন্ধ করে দিয়েছিল।
এ সবই অতীত। পর্ষদ-সূত্রেই জানা যাচ্ছে, ২০০৬ পর্যন্ত কালীপুজো-দীপাবলির দু’রাত পর্ষদের কন্ট্রোল রুম খোলা থাকত। ভাসানের মিছিলেও নজরদারির ব্যবস্থা ছিল। ২০০৬-এর পরে ছবিটা পাল্টে গিয়েছে। এখন শুধু কালীপুজোর রাতে পর্ষদের কন্ট্রোল রুম চালু থাকে। ভাসানে নজরদারির বালাই নেই।
কেন নেই জানতে চাইলে পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র মন্তব্য করতে চাননি। অন্য দিকে আইনজীবী গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায় মনে করছেন, শব্দের দাপাদাপি ঠেকাতে পুলিশ যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, তবে তা বিলক্ষণ সংবিধান বিরোধী। সেই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপন্থীও বটে। বস্তুত গীতানাথবাবুদের লাগাতার প্রচেষ্টাতেই শব্দদূষণ প্রতিরোধে কলকাতা হাইকোর্টে গ্রিন বেঞ্চ হয়েছে। ২০০৫-এ সুপ্রিম কোর্টের যে মামলায় রাত দশটার পরে প্রকাশ্যে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ হয়, তাতেও গীতানাথবাবুরা সক্রিয় ছিলেন।
পুলিশের কী বক্তব্য?
লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। যার ফলে শব্দবাজির তাণ্ডব অনেকটা কমানো গিয়েছে। কিন্তু ভাসানের উৎপাত? পুলিশকর্তাটির প্রত্যয়ী জবাব, ‘‘এ বার যেটা পারলাম না, পরের বার নিশ্চয় পারব।’’
আইনরক্ষকের আশ্বাসে বুক বাঁধা ছাড়া আম নাগরিকের উপায় কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy