Advertisement
E-Paper

পাভলভ থেকে পরিবার, মাঝে পার ২৬ বছর

কলকাতার হাসপাতাল থেকে পুরুলিয়ার বাড়িতে ফিরতে ছাব্বিশটা বছর সময় লাগল কল্পনা প্রামাণিকের। ২৬ বছর আগে মানসিক রোগিণী মেয়েকে কলকাতার পাভলভ হাসপাতালে ভর্তি করে গিয়েছিলেন তাঁর মা। সঙ্গে ছিলেন কল্পনার বড়দা। আর ফেরত নিয়ে যাননি। অভাবের সংসারে একটা খাওয়ার পেট কমেছিল।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:২৯
কল্পনা প্রামাণিক

কল্পনা প্রামাণিক

কলকাতার হাসপাতাল থেকে পুরুলিয়ার বাড়িতে ফিরতে ছাব্বিশটা বছর সময় লাগল কল্পনা প্রামাণিকের।

২৬ বছর আগে মানসিক রোগিণী মেয়েকে কলকাতার পাভলভ হাসপাতালে ভর্তি করে গিয়েছিলেন তাঁর মা। সঙ্গে ছিলেন কল্পনার বড়দা। আর ফেরত নিয়ে যাননি। অভাবের সংসারে একটা খাওয়ার পেট কমেছিল। অন্য ছেলেমেয়ে কিংবা আত্মীয়-পরিজনেরা যখন কল্পনার কথা জানতে চেয়েছিলেন, মা বলেছিলেন ‘কল্পনা হারিয়ে গিয়েছে।’ এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে এবং নিজের ভাইয়ের আন্তরিকতায় শেষ পর্যন্ত প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে পরিবারের কাছে ফিরলেন কল্পনা।

স্বাস্থ্য দফতরের বক্তব্য, এ রাজ্যে সেরে উঠেও মানসিক হাসপাতালে যাঁরা বছরের পর বছর থেকে যেতে বাধ্য হন, তাঁদের তালিকার একেবারে শীর্ষে ছিল কল্পনা প্রামাণিকের নাম। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ভর্তির এক বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। ডাক্তাররা তাঁকে ছুটিও দিয়ে দেন। চিঠি দেওয়া হয় বাড়িতে। কিন্তু তার কোনও জবাব আসেনি। ফলে হাসপাতালটাই ক্রমে স্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠেছিল ওঁর।

মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে তার পর আর ফেরত না-নিয়ে যাওয়ার নজির ভূরি ভূরি। এই কারণেই হাসপাতালগুলিতে শয্যার অভাব কখনও মেটে না। ৫৫ বছরের কল্পনাও ছিলেন তাঁদেরই একজন হয়ে। এত দিনে ঘরে ফিরতে
পারার নজির যদি আরও অনেককে উদ্বুদ্ধ করে, সেই আশাতেই রয়েছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা।

যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওই হাসপাতালের রোগীদের পুনর্বাসনে কাজ করে, তাদেরই এক সদস্য দিন কয়েক আগে কথাপ্রসঙ্গে ফের কল্পনাদেবীর কথা জানতে পারেন। তিনিই পুরুলিয়ায় গিয়ে পুলিশের সাহায্য নিয়ে যোগাযোগ করেন কল্পনার বাড়িতে। জানা যায়, মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করার এক বছরের মধ্যে আচমকাই অসুস্থ হয়ে মারা যান কল্পনার মা। তার বছর কয়েকের মধ্যেই পক্ষাঘাতে পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যান তাঁর দাদা। ব্যস, বাড়িতে কল্পনা-পর্বের ওখানেই ইতি। সংস্থার ওই কর্মী শুক্লা দাস বড়ুয়া বলেন, দাদার বাড়ি থেকে তাঁদের নিরুপায় অবস্থার কথা জানিয়ে কল্পনার এক ভাইয়ের বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হয়। তাঁরাও পুরুলিয়াতেই থাকেন। ‘‘আমরা যখন সেই ভাই এবং তাঁর স্ত্রীকে বিষয়টি জানাই। ওঁরা জানান, দিদি কোথায় আছেন সে সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও এত দিন ওঁদের ছিল না। সানন্দে দিদিকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হন ওঁরা।’’

এর পরই চেনা ছক থেকে অন্য দিকে মোড় নেয় ঘটনা। যেখানে নানা অজুহাতে বাড়ির লোকজনকে মানসিক হাসপাতালে রেখে দেওয়াটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে কল্পনাদেবীর ভাই স্বপন প্রামাণিক ও তাঁর স্ত্রী দিদিকে বাড়ি ফেরত নিয়ে আসেন। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘বহু জীবন এ ভাবেই হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভিতরে শেষ হয়ে যায়। কল্পনাদি যে তার ব্যতিক্রম হয়ে উঠতে পারলেন, সেটাই আমাদের কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সাফল্য।’’ কিন্তু অভিযোগ, সব কিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরেও ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দেওয়ার আগে ডাক্তাররা বলেছিলেন, যাঁরা ভর্তি করিয়েছিলেন, ছুটির সময়েও তাঁদেরই আসতে হবে। অর্থাৎ মৃত মা আর শয্যাশায়ী দাদাকে যেন হাসপাতালে হাজির করা হয়! ‘‘স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা সাহায্য না করলে কল্পনাদিকে বাড়ি পাঠাতে অনেক বেগ পেতে হতো,’’ বললেন রত্নাবলী।

ভাইয়ের বাড়িতে বসে কান্না বুজে আসা গলায় কল্পনা বলেন, ‘‘আগে তো জানতাম, যাবজ্জীবন কারাবাস হলেও ১২ বছর পর ছাড়া পাওয়া যায়। আমার তো দু’-দুবার যাবজ্জীবনের পরেও ছাড় মেলেনি। বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, শেষ নিঃশ্বাসটাও হাসপাতালেই পড়বে। বাবু (স্বপনবাবুর ডাক নাম) আর বাবুর বউয়ের জন্যই বাইরের পৃথিবীটা দেখার সুযোগ পেলাম।’’

বাবু অর্থাৎ স্বপনবাবু একটি ব্যাঙ্কের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। নিত্য টানাটানির সংসার। নীলকুঠিডাঙায় দু’ঘরের ভাড়াবাড়িতে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে থাকেন। দিদির জন্য একটা ঘর ছেড়ে দিতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ফের এক জনের দায়িত্ব নিলেন? স্বপনবাবুর জবাব, ‘‘কী করব? নিজের দিদি ওই ভাবে হাসপাতালে পড়ে আছে জেনেও ফিরিয়ে নেব না? আমাদের ডাল-ভাত জুটলে দিদিরও জুটবে।’’

kalpana pramanik returns Pavlov mental hospital
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy