Advertisement
০২ মে ২০২৪

মমতা-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে পুরসভার চুক্তি ভেঙে দু’ভাগ

লিজ চুক্তি ভেঙে লেক মলের নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন প্রাইভেট লিমিটেডকে ‘বিশেষ’ সুবিধা পাইয়ে দিল কলকাতা পুরবোর্ড। যার জেরে রাজস্ব বাবদ রাজ্য সরকারের প্রায় ২৪ কোটি টাকা আয় কম হবে বলে জানাচ্ছেন পুরকর্তারাই। পুরসভার হাতে থাকা লেক বাজারকে ভেঙে মল তৈরির ব্যাপারে ১৯৮৭ সালে বড়বাজারের অরুণ প্লাস্টিক প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল পুরসভার। পুর নথি অনুযায়ী চুক্তির মেয়াদ ৬০ বছর।

লেক মল উদ্বোধনে শ্রীকান্ত মোহতা, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।  —ফাইল চিত্র

লেক মল উদ্বোধনে শ্রীকান্ত মোহতা, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র

অনুপ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২৬
Share: Save:

লিজ চুক্তি ভেঙে লেক মলের নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন প্রাইভেট লিমিটেডকে ‘বিশেষ’ সুবিধা পাইয়ে দিল কলকাতা পুরবোর্ড। যার জেরে রাজস্ব বাবদ রাজ্য সরকারের প্রায় ২৪ কোটি টাকা আয় কম হবে বলে জানাচ্ছেন পুরকর্তারাই।

পুরসভার হাতে থাকা লেক বাজারকে ভেঙে মল তৈরির ব্যাপারে ১৯৮৭ সালে বড়বাজারের অরুণ প্লাস্টিক প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল পুরসভার। পুর নথি অনুযায়ী চুক্তির মেয়াদ ৬০ বছর। এর পর অরুণ প্লাস্টিক লিমিটেড নাম পাল্টে হয় ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন প্রাইভেট লিমিটেড। পুরনো মডেল লিজ চুক্তির সূত্র ধরে ২০১০ সালে তাদের সঙ্গে ফের চুক্তি করে পুরসভা। কিন্তু সম্প্রতি ৬০ বছরের চুক্তিকে ভেঙে দু’ভাগ করে ৩০ বছর মেয়াদের দু’টি চুক্তি করার আবেদন জানায় ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন। গত ১১ সেপ্টেম্বর পুরসভার মেয়র পারিষদের বৈঠকে সেই আবেদন গ্রাহ্য হয়েছে।

লিজ চুক্তি ভেঙে দু’ভাগ করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হবে কী ভাবে?

সরকারি আইন অনুযায়ী, লিজ চুক্তি ৩০ বছরের বেশি হলে লিজ রেজিস্ট্রেশন করাতে সম্পত্তির বাজার দর (মার্কেট ভ্যালু) ধরে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয়। কিন্তু ৩০ বছর বা তার কম হলে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয় গড় লিজ ভাড়ার (অ্যাভারেজ লিজ রেন্ট) ভিত্তিতে। এই হিসেবে লিজ চুক্তির মেয়াদ ৬০ বছর থাকলে ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হতো ২৪ কোটি টাকা। এখন চুক্তি দু’ভাগে ভাঙার ফলে দিতে হবে মাত্র ৭ লক্ষ টাকা। শুধু স্ট্যাম্প ডিউটিতে বিপুল ছাড়ই নয়, লিজ ভাড়ার ক্ষেত্রেও ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে পুরসভা। আর একটি পুনর্নির্মিত পুরবাজার নিউ আলিপুর মার্কেটের ডেভেলপারের ক্ষেত্রে যখন লিজ ভাড়ার পরিমাণ বর্গফুট পিছু ২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা করা হয়েছে, তখন লেক মলের ক্ষেত্রে তা ১ টাকা ৬৩ পয়সাতেই বেঁধে রাখা হয়েছে।

কে এই ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন? যাদের জন্য পুরসভার এই বদান্যতা!

এক পুরকর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের তালিকায় রাজ্যে যে কয়েক জন শিল্পোদ্যোগীর নাম রয়েছে, তাঁদেরই এক জন সিনেমা প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা। ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন সংস্থার কর্ণধার তিনিই।” গত বছর লেক মলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চেই ভেঙ্কটেশ কর্তার প্রশংসা করেন তিনি। এ বার সেই সংস্থাকে ‘তুষ্ট’ রাখতে নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরবোর্ড। যাকে অনিয়ম বলেই বলে মনে করছেন পুরসভার একাধিক আধিকারিক, এমনকী কাউন্সিলররাও। তৃণমূলেরই এক কাউন্সিলরের কথায়, “ভেঙ্কটেশ সংস্থার কর্ণধার খোদ মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন। তাই নিয়ম ভেঙে তাঁকে খুশ করা হচ্ছে।” প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “শুরু থেকেই এই পুরবোর্ড ধান্দাবাজ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ করছে। শুধু লেক মল নয়, এমন ঘটনা আরও আছে।”

অথচ ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনের আবেদন মানা যাবে না বলে গত ৩০ জুনই সিদ্ধান্ত হয়েছিল মেয়র পারিষদের বৈঠকে। সংস্থার প্রস্তাব ছিল, মোট ৬০ বছরের চুক্তির প্রথম ৩০ বছর ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন এবং বাকি ৩০ বছর তাদেরই নমিনি মেসার্স বি এম লেসার্স এলএলপি’র নামে দেওয়া হোক। সেই প্রস্তাব বাতিল করে তখন পুরনো লিজ চুক্তি মেনে চলারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পুরসভা সূত্রের খবর, সম্প্রতি নিজের চেম্বারে ভেঙ্কটেশের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতার সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। আর তার পরেই ১১ সেপ্টেম্বর মেয়র পারিষদের বৈঠকে ভেঙ্কটেশ সংস্থার আবেদন অনুমোদন করে পুরবোর্ড। যদিও এই প্রস্তাব মেনে লিজের মেয়াদ ভাগ করে দিলে যে রাজস্ব আদায় কমবে, সে কথা লিখিত নোট দিয়ে পুর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিল পুরসভার অর্থ দফতর। সেই আপত্তি উপেক্ষা করে বিশেষ একটি সংস্থাকে ‘সুবিধা’ পাইয়ে দেওয়া নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে পুরসভার অন্দরমহলে।

লেক মলে মোট জায়গার পরিমাণ ১৯ হাজার ৯২৫ বর্গ মিটার। লিজ চুক্তি অনুযায়ী পুরনো বাজারের সব দোকানদারকে পুনর্বাসন দিতে গিয়ে একতলায় ৩২৯৮ বর্গমিটার জায়গা খরচ হয়েছে। ৬ ও ৭ তলায় পুরসভাকে দিতে হয়েছে এক হাজার বর্গমিটার জায়গা। বাকি ১৫ হাজার বর্গমিটার বা ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭৪০ বর্গফুট জায়গা পুরসভার অনুমতি নিয়ে ভাড়া দিতে পারবে নির্মাতা সংস্থা। এই জায়গাটুকুই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে তাদের।

রাজ্য সরকারের স্ট্যাম্প ডিউটি আইন অনুযায়ী (ইন্ডিয়ান স্ট্যাম্প, ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১২) লিজ চুক্তির মেয়াদ ৬০ বছর থাকলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাজার দরের উপর ৭ শতাংশ হারে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হতো ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে। লেক মল এলাকায় বাণিজ্যিক নির্মাণের বাজারদর এখন বর্গফুট পিছু ২০ হাজার টাকারও বেশি। সেই হিসেবে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭৪০ বর্গফুটের দাম দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩৩৫ কোটি টাকা। সুতরাং রেজিস্ট্রেশনের জন্য স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হতো ২৪ কোটি টাকা।

কিন্তু ৩০ বছর বা তার কম সময়ের জন্য কোনও লিজ চুক্তির রেজিস্ট্রি করার ক্ষেত্রে যে হেতু লিজ ভাড়ার ভিত্তিতে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয়, সে হেতু এই বিপুল পরিমাণ টাকা দেওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন। তাদের সঙ্গে পুরসভার লিজ ভাড়া চুক্তি হয়েছে প্রতি বর্গফুটে ১ টাকা ৬৩ পয়সা। ফলে স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ লাগবে মাত্র ৬ লক্ষ ৮৪ হাজার ৯০১ টাকা।

ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে এই সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরসভার যুক্তি কী? একাধিক কাউন্সিলরের কথায়, “পিপিপি মডেলের বিষয়টি মেয়র নিজেই দেখেন। অনিয়ম হয়ে থাকলে তার দায়ও তাঁকেই নিতে হবে।”

মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “চুক্তি যা হয়েছিল, আমরা সে অনুযায়ীই কাজ করেছি। সরকারের কোনও লোকসান হবে না।” যদিও পুরসভার এক আধিকারিক জানিয়েছেন, চুক্তিতে যদি এমনটা থাকত, তা হলে অর্থ দফতর ওই নোট দিত না। ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি এ ব্যাপারে কোনও কথা বলব না।” শুধু স্ট্যাম্প ডিউটি নয়, লিজ ভাড়ার ক্ষেত্রেও ভেঙ্কটেশকে সুবিধা দিচ্ছে পুরসভা। নিউ আলিপুর মার্কেটের ডেভেলপারকে এত কাল প্রতি বর্গফুটে ২ টাকা করে ভাড়া মেটাতে হতো পুরসভাকে। ওই সংস্থার সঙ্গেও পুরসভার চুক্তি হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। গত ১১ অগস্ট পুরসভার মেয়র পারিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ওই সংস্থাকে প্রতি বর্গফুটের জন্য ২ টাকার পরিবর্তে ৪ টাকা করে ভাড়া দিতে হবে। অথচ লেক মলের ক্ষেত্রে কোনও ভাড়া বাড়ানো হয়নি। সেই ১ টাকা ৬৩ পয়সা হারই বজায় রয়েছে।

একই ধরনের দু’টি বাজারের ক্ষেত্রে দু’রকম সিদ্ধান্ত কেন?

মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “লেক মলের ক্ষেত্রে নির্মাণ সংস্থার সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে ভাড়া বাড়ানোর কোনও কথা বলা নেই। তাই ভাড়া বাড়ানো হয়নি।” যদিও এক পুর-অফিসারের কথায়, নিউ আলিপুর বাজারের নির্মাণ সংস্থার সঙ্গে চুক্তিতেও ভাড়া বাড়ানোর কোনও কথা ছিল না। সময়ের পরিবর্তনের কথা ভেবেই তা বাড়ানো হয়েছে। একই ভাবে লেক মলেরও ভাড়া বাড়ানো দরকার ছিল। কিন্তু ‘বিশেষ’ কারণে তা হয়নি। পুরসভার এক অফিসারের কথায়, “লেক মলের দোতলায় একটি সংস্থার কাছ থেকে ভেঙ্কটেশ সংস্থা ভাড়া নিচ্ছে প্রতি বর্গফুটে ৩৫ টাকা। অথচ পুরসভাকে দিচ্ছে মাত্র ১ টাকা ৬৩ পয়সা।”

আরও অভিযোগ, ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন একাধিক সংস্থার কাছ থেকে সেলামি নিয়ে লেক মলে জায়গা দিয়েছে। সেই সব সংস্থার সঙ্গে লিজ চুক্তিও করেছে। যদিও পুরসভার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, তা তারা করতে পারে না। এ সবই পুরসভার কর্তারা জানেন। তা সত্ত্বেও ভেঙ্কটেশ সংস্থার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE