রাজ্যের নানা জায়গার মতো বর্ধমানেও আস্তে আস্তে কোয়েল পাখির মাংস ও ডিমের চাহিদার কথা ভেবে পরীক্ষামূলক ভাবে তা চাষ শুরু হয়েছে। তবে সরকারি ভাবে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। কিন্তু বর্ধমানের রথতলায় দুই চিকিৎসক তাঁদের খামার বাড়িতে কোয়েল চাষ শুরু করেছেন সম্প্রতি।
তাঁদের এক জন বর্ধমানের বিশিষ্ট অস্থিরোগ চিকিৎসক সুচিন্দ্রম পাত্র। অন্য জন, বর্ধমানের লাকুরডির বাসিন্দা সৌমেন সিংহরায়। সুচিন্দ্রমবাবু জানান, কিছু দিন আগে নিজের বাড়িতে শখ করেই কোয়েল পাখির প্রতিপালন শুরু করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘নিজের বন্ধু ও পরিচিত মহলে দেখি কোয়েলের ডিম ও মাংসের চাহিদা রয়েছে। তবে এখনও ঠিক বাণিজ্যিক ভাবে কাজ শুরু করিনি। তবে কেউ যদি কোয়েলের চাষ করে তবে তাকে আমরা প্রযুক্তি ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করব।’’
তিনি জানান, কোয়েল পাখি প্রথমে পোলট্রিতে বড় হয়। এরা ডিম ফোটানোর সময় তা দেয় না। ইনকিউবেটরে বাচ্ছা ফোটানো হয়। ১৬–১৮ দিন লাগে ডিম ফোটাতে। ডিমের ওজন হয় ৭-১৫ গ্রাম। ৯ গ্রাম থেকে ১৫ গ্রাম ওজনের ডিম থেকে ভাল বাচ্ছা হয়। পাখির ওজন হয় ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম। ডিম থেকে পাখি হতে মোটামুটি ১৮ দিন। পূর্ণ মাপের পাখি হতে লাগে ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ। তার পরেই ডিম দেবে পাখি। প্রথম বছরে ২৮০ থেকে ৩০০ ডিম মিলবে। তারপর ডিমের পরিমাণ কিছু কমবে।
তবে শীত কালে কোয়েলের ডিম দেওয়ার পরিমাণ খুবই কম। তিন মাস সময়কালে শীতে জবুথবু কোয়েলকে কৃত্রিম ভাবে আলো জ্বালিয়ে ইনকিউবেটরে রাখলে অবশ্য ডিম মিলবে। পাখির জন্য খাবার লাগে ৩০ গ্রাম মতো। বাজারের ব্রয়লার মুরগি ও পশুখাদ্য মিক্সচারই তাদের সাধারণ খাবার। দাম ৩০ টাকা প্রতি কেজি। পাখিগুলির জীবনকাল ৩ থেকে ৪ বছর। তবে ৬ সপ্তাহ পরেই মাংস হিসেবে বিক্রি করা হয় বাজারে। বর্ধমানের বাজারে ২০০ গ্রাম ওজনের পোলট্রি খামারে উৎপাদিত কোয়েলের দাম ৫০ টাকা। তবে বুনো কোয়েল, যার নাম তিতির পাখি, তার প্রতিপালন অবশ্য নিষিদ্ধ।
সুচিন্দ্রমবাবু জানান, প্রথমে কলকাতার টালিগঞ্জের পোলট্রি ফার্ম থেকে ৫০টি পাখি কেনেন তিনি। পরে তা আস্তে আস্তে বেড়েছে। ২০০ পাখি বিক্রি হয়েছে ৮-৯ মাসের মধ্যে। বর্ধমানের বাজারে এই পাখির মাংস ও গোটা পাখির চাহিদা রয়েছে। সৌমেনবাবু জানান, ১ দিনের বাচ্চার দাম ১০ টাকা। ৫ সপ্তাহের পাখির প্রায় ২০০ গ্রাম মতো ওজন হয়। দাম ৫০ টাকা। বর্ধমানের ছোট নীলপুরের একটি রেস্তোরাঁয় কোয়েলের মাংস ও রোস্ট বিক্রিও হচ্ছে। মুরগির মাংসের মতোই মোটামুটি ৭-৮ পিস ১০০ টাকা প্লেট।
দু’জনেই জানান, মোটামুটি ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা হলেই শেড, ইনকিউবেটর, লোহা ও তারের খাঁচা সহ ১০০টি পাখি দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করা যাবে। ২–৩ মাস পর থেকেই উৎপাদন শুরু হলে পর্যায়ক্রমে তা বাড়তে থাকবে। ৫ মাস পর থেকেই তা বাজারে বিক্রির জন্য যাবে।
কোয়েল চাষের ঝুঁকিও কম। মুরগির মতো কোন টিকা দিতে হয় না। নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এদের বেশি। কোলেস্টরল হয় না। ফ্যাট বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ কম থাকায় যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাঁদের জন্য উপকারী। ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্যও এটি উপকারী।
ডিমের দাম পাইকারি ১ টাকা পিস। খুচরা দু’টাকা। তবে আকৃতি ও পরিমাণে ছোট হওয়ায় তিনটি ডিম গুললে একটি মুরগি বা হাঁসের ডিমের সমান হবে। ডিমের ওজন ৭–১৫ গ্রাম। কিন্তু প্রচার ও প্রসারের অভাবে এই কোয়েলের মাংস ও ডিম চাষ তেমন জনপ্রিয় হয়নি বর্ধমানে। বর্ধমান জেলা পরিষদের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ কর্মাধ্যক্ষ অলোক মাঝি বলেন, ‘‘কোয়েলের মাংস ও ডিম অত্যন্ত সুস্বাদু। কিন্তু বর্ধমান জেলায় এটির তেমন প্রচার নেই। নদিয়াতে রীতিমতো বাজার আছে। যদি কেউ কোয়েল চাষ ও প্রতিপালনে আগ্রহী হন বা ব্যবসায় নামেন, তা হলে আমরা তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করব।’’
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বর্ধমানের হাট গোবিন্দপুরে রাজ্য প্রাণিসম্পদ মেলায় কোয়েল পাখি ও তার ডিমের প্রদর্শনী হয়েছিল। দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, ‘‘কোয়েল পাখির ডিম ও মাংসের জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় স্টল সহ প্রচার চালাচ্ছি। এর প্রসার ও একটি আধুনিক বিপণন পরিকাঠামো তৈরিরও চেষ্টা করা হচ্ছে।’’ সেই সঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও রুচি বদল করা কঠিন কাজ তাই তার জন্য অপেক্ষাও করতে হবে। একই কথা বলেছেন বর্ধমান রাজ কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক সুনীল সাঁইও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy