কলকাতার হোটেলে বসে ঢাকার গুলশনের ‘হলি আর্টিজান বেকারি’ নামটা শুনেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল জোসেফ রোজারিওর। ঢাকার কাঁকরাইলের পড়শি ‘আঙ্কল’ জন দেসাই আর খুড়তুতো ভাই সুপ্রিয় লুইস গোমেজ তো ঢাকার ওই অভিজাত রেস্তোরাঁতেই কাজ করেন!
শুক্রবারের রাতে তখনই ভিডিও কলে গোমেজকে ধরেন জোসেফ। ‘‘রমজানি মরসুমে রেস্তোরাঁ এখন আধবেলা খোলা থাকছে। নাহ্, ওদের কারও তখন ডিউটি ছিল না। ভাগ্যিস!’’ শনি-দুপুরে এ শহরে মির্জা গালিব স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁয় মাছ-ভাত খেতে খেতে বলছিলেন জোসেফ। কিন্তু জঙ্গি হানায় নিজের শহরের রক্তাক্ত হওয়ার খবরটা ছুটির সব আলো যেন শুষে নিয়েছে।
ঢাকার পল্টনমোড়ের চিনে রেস্তোরাঁর মালিক তথা সিনেমা-নাটকের অভিনেতা জোসেফ ইদের সময়ে ক’দিনের জন্য সপরিবার বেড়াতে এসেছেন এ শহরে। সঙ্গে আছেন আরও দুই নাট্যকর্মী বন্ধু, শেখ মহম্মদ সুলতান ও মহম্মদ জাকারিয়া। ওই রাতে সুলতানের স্ত্রীই ফোন করে গুলশনের রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হানার খবরটা দিয়েছিলেন। তার পরেই সবাই হুড়মুড়িয়ে টিভি-র নিউজ চ্যানেলের সামনে। রাতভর। বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন নিহত! শুনেই জাকারিয়ার চোখ ছলছলিয়ে উঠেছিল। অনেক দিনের পরিচয় ঢাকার ওই মেধাবী পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। সালাউদ্দিন তখন মিরপুরে পল্লবী থানার ওসি। আর জাকারিয়া ওই তল্লাটে আওয়ামি লিগের ছাত্রনেতা। ‘‘খুবই দক্ষ আর সৎ পুলিশ অফিসার!’’ এ দিন দুপুরে নিজের স্মার্টফোনের গ্যালারিতে উর্দিধারী সালাউদ্দিনের ঝকঝকে ছবিটা ঘাঁটছিলেন তিনি।
জঙ্গি হামলায় ধ্বস্ত ঢাকার পাশে দাঁড়াতে এ দিন শহর জুড়ে নানা অনুষ্ঠানে পথে নেমেছে কলকাতা। আর নিউ মার্কেট লাগোয়া ফ্রি স্কুল স্ট্রিট-মার্কুইস স্ট্রিটে হোটেল পাড়ায় কলকাতার ভিতরের ‘এক টুকরো বাংলাদেশ’ও টালমাটাল। এমন নয় যে, বিপদের একটা আশঙ্কা কারও ছিল না। তবে এত দিন যেটা বিক্ষিপ্ত হামলা বা ব্যক্তির উপরে আক্রমণ বলে শোনা যাচ্ছিল, সেটা সংগঠিত জঙ্গি হামলার চেহারা নেওয়ায় ধাক্কাটা খানিক বেশি। সল্টলেকের বেসরকারি হাসপাতালে নামী অস্থিরোগ বিশারদকে দেখিয়ে ফেরার পরে ধানমন্ডির সাহা দম্পতি তাই ঘোর-লাগা চোখে তাকিয়ে আছেন। হাঁটুর যন্ত্রণার থেকেও বেশি কষ্ট দিচ্ছে মাতৃভূমির দুর্যোগ। ঢাকার নামী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা নাম বলতে চাইলেন না। শুধু বললেন, ‘‘গত দু’-পাঁচ বছরে বাংলাদেশে নানা ভাবে উন্নয়ন হয়েছে। ভারী শিল্প অবধি আসছে। কিন্তু মৌলবাদের থাবাটা সরানো যাচ্ছে না।’’
উত্তর বাংলাদেশের গাইবান্ধার বাসিন্দা, সরকারি কর্মচারী তথা কলেজ শিক্ষক দম্পতিও চাকরির তাড়নাতেই নামপ্রকাশে অপারগ। তিন বছরের ছেলেকে চেন্নাইয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে এ দিনই খবরটা পেয়েছেন। বলছেন, ‘‘সরকারি চাকরির জন্য আমাদের তা-ও ভিসা পেতে সমস্যা নেই। কিন্তু এ সব ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। জঙ্গি প্রভাবের জন্যই সাধারণ মানুষের ইন্ডিয়ার ভিসা পেতে কষ্ট। এক-একটা ঘটনা দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে।’’
কর্ণফুলি পেপার মিলের প্রাক্তন কর্তা, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতা নইমুল আহমেদ চৌধুরীও এ দিন বিকেলেই ২০ ঘণ্টার বাস সফর সেরে শহরে নামলেন। তিনি অবশ্য বলছেন, ‘‘যারা বাংলাদেশের উন্নয়নের বিরুদ্ধে, তাদের জন্যই এমন ঘটনা হইসে।’’ কিন্তু আম বাংলাদেশি নাগরিকের উৎকণ্ঠা তাতে ফিকে হচ্ছে না। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের তরুণ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ ইফতিকার মাহমুদ কিছু দিন আগে গুলশনেই একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। হামলার রাতে কুষ্টিয়া থেকে আম্মুর ফোনে খবরটা পেয়েছিলেন। মা বলছিলেন, তুই তো ঢাকায় কাজ করিস! সাবধানে থাকিস বাবা! ইদের আগে শপিংয়ের জন্য কলকাতায় আসা যুবকের কাছে উৎসবের রংটাই এখন ফিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy