জাজেস কোর্ট রোডে লাল রঙের, ২১ ফুট উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়িটি হয়তো আরও কিছু দিন থাকবে। কিন্তু ক্রমে কালের গর্ভে সে-ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জানতেও পারবে না, ব্রিটিশ জমানায় ওই লাল বাড়িতেই দীর্ঘ বন্দিজীবন কাটিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহরু, বিধানচন্দ্র রায়। কারণ, মঙ্গলবারই আলিপুর সেন্ট্রাল জেল শূন্য হল। বন্দিদের নতুন ঠিকানা হল বারুইপুর জেল।
১৯০৬ সালে আদি গঙ্গার পাড়ে তৈরি হয় আলিপুর জেল। ভাবনা ছিল, জেলের মাঝখানে থাকবে টাওয়ার। সেটি ঘিরে তৈরি হবে বিভিন্ন ওয়ার্ড। মাঝের ওই টাওয়ার থেকে বন্দিদের অজ্ঞাতসারে সব ওয়ার্ডেই চোখ রাখতে পারবেন নজরদার। যেহেতু বন্দিরা বুঝতে পারবেন না যে কখন তাঁকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে, তাই এমন পরিবেশে তাঁরা কাজ করতে উৎসাহিত হবেন। এতে তাঁদের ব্যবহারেও পরিবর্তন আসবে। তেমন ভাবনা থেকেই গড়ে ওঠে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল।
ব্রিটিশ জমানায় আলিপুর জেলের কুঠুরিতে দীর্ঘ ন’মাস কাটাতে হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুকে। তাঁর স্মরণে সেখানে তৈরি হয়েছে ‘নেতাজি ভবন’। এই জেলেরই দোতলায় আট নম্বর সেলে ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বন্দি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। আবার ১৯৩২ সালের অক্টোবর থেকে পরের বছরের জুন পর্যন্ত বন্দিদশা কাটান দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ওই ভবনের একতলার চার নম্বর সেল বহু বছর ঠিকানা ছিল বিধানচন্দ্র রায়ের। পরবর্তীকালে ওই সেলগুলির সামনে মূর্তি বসেছে সুভাষচন্দ্র-চিত্তরঞ্জন-বিধান রায়ের। রয়েছে তাঁদের নামের ফলকও।
নেতাজি ভবনের অদূরেই বন্দি ছিলেন জওহরলাল নেহরু। ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত জেলের কুঠুরিতেই বন্দিদশা অতিবাহিত করতে হয়েছিল তাঁকে। পরে ওই বাড়িটির নামকরণ করা হয় নেহরুর নামেই।
১৯২৬ সালে আলিপুর জেলে ফাঁসি হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী অনন্তহরি মিত্র ও প্রমোদরঞ্জন চৌধুরীর। ১৯৩১ সালে এই জেলেই দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসিকাঠে চড়ায় ব্রিটিশ সরকার। তিন বছরের ব্যবধানে, ১৯৩৪ সালে দীনেশ মজুমদারেরও একই পরিণতি হয়েছিল। শুধু ফাঁসিই নয়। ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারে জেলেই মারা যান স্বাধীনতা সংগ্রামী রাধাচরণ পাল, আসিধারী ঘোষ, অম্বিকাচরণ বসু এবং ফণীন্দ্রলাল নন্দী।
ইতিহাসের সে সব অধ্যায়কে সাক্ষী রেখে এ দিন ১০টি গাড়িতে নতুন ঠিকানায় গেলেন ১১৮ জন বন্দি। তাঁদের মধ্যে ৭১ জন সাজাপ্রাপ্ত। আলিপুর প্রেসের সঙ্গে যুক্ত থাকা সাজাপ্রাপ্ত ৩০ বন্দির ঠিকানা হল প্রেসিডেন্সি সেন্ট্রাল জেল। আর কয়েক দিন আগে আলিপুরে আসা ৪৭ জন বিচারাধীন বন্দিকে নিয়ে যাওয়া হল বারুইপুরে। আলিপুর জেলের ২৫টি ওয়ার্ডে প্রায় ২০০০ বন্দি ছিলেন। কারও দশ বছর, কারও পনেরো, কারও বিশ বছরের ঠিকানা ছিল এই ‘ঘর’। সূত্রের খবর, রাত পৌনে ন’টা পর্যন্ত বন্দি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলে।
আলিপুর জেলের অন্দরে ছাপাখানায় প্রায় দু’শো সরকারি কর্মীর সঙ্গে কাজ করতেন ১০০ জন বন্দিও। সেই ছাপাখানায় এ দিন অবশ্য কাজ হয়নি। সেখানে প্রেসিডেন্সি থেকে বন্দিদের আনা হবে কি না, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি কারা দফতর। জেলের ছাপাখানা দেখভালের জন্য কয়েক দিন থাকবেন জনা বারো-পনেরো কারাকর্মী। এ দিনের পরে বারুইপুরে বন্দি সংখ্যা প্রায় সাড়ে ন’শোর কাছাকাছি পৌঁছল বলে খবর। কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস জানিয়েছেন, জেলের যে সব বিভাগ পুরোপুরি খালি হয়েছে, সেখানকার চাবি সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
আলিপুর জেল খালি হওয়ার এই টুকরো টুকরো ছবিগুলো যেন স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তস্নাত ইতিহাসকেই ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দিল।