Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
COVID-19

বাঁচতে হবে, এই জেদে নিজেই অক্সিজেন চালাই

আমি ব্যান্ডেলের মেয়ে। সেখানকারই বাসিন্দা বিশ্বনাথ বসুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আমার। বিশ্বনাথ স্কুলে পড়াতেন।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২১ ০৭:১৭
Share: Save:

মনে হচ্ছিল গলার কাছে কিছু একটা চেপে বসছে। দম আটকে এখনই সব শেষ হয়ে যাবে। সেই অবস্থাতেই কোথাও শয্যা না পেয়ে শ্যামবাজারের একটা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলাম। দু’দিন ধরে সেখানে যা হল, তাতে মনে হয়েছিল এখানে থাকলে আর বাঁচব না। ঠিক করেছিলাম, বাঁচতে আমাকে হবেই। জোর করেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসি। সিলিন্ডার আনিয়ে নিজেই অক্সিজেন চালিয়ে লড়ে গিয়েছি। শেষে করোনাকে হারিয়েই ছেড়েছি।

আমি ব্যান্ডেলের মেয়ে। সেখানকারই বাসিন্দা বিশ্বনাথ বসুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আমার। বিশ্বনাথ স্কুলে পড়াতেন। আমাদের এক মাত্র ছেলে, বছর আটাশের দেবব্রত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সন্তোষপুরের ত্রিকোণ পার্কে পাকাপাকি চলে আসি। দেবব্রত যাদবপুর থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন প্যারিসে কর্মরত।

গত ১০ এপ্রিল আমি আর আমার স্বামী ব্যান্ডেলে গিয়েছিলাম ভোট দিতে। ১১ তারিখ সেখান থেকে ফিরেই জ্বর আসে আমার। করোনা পরীক্ষা করাতেই রিপোর্ট পজ়িটিভ আসে। ছেলে তখন টিকিট কেটে চলে আসার তোড়জোড় করছে। এ দিকে কিছুতেই বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। কয়েক জন বন্ধুর কাছে ছেলে সাহায্য চাইল। ১৮ এপ্রিল শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৮০-তে নেমে যেতে শুরু করল। তত ক্ষণে স্বাস্থ্য ভবনের নম্বরে ফোন করা হয়ে গিয়েছে। তাঁরা তখনও শয্যার কথা বলতে পারছেন না। ছেলের এক বন্ধু যে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলিয়েছিল, তিনিই শ্যামবাজারের ওই হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা আছে জানিয়ে চলে আসতে বলেন।

১৯ তারিখ দুপুরে সেখানে ভর্তির পর থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কোনও খাবার দেওয়া হল না আমায়। সেই সঙ্গে ছিল কর্মীদের দুর্ব্যবহার। পরদিনও সকাল থেকে কোনও খাবার দেওয়ার ব্যাপার ছিল না। মনে হচ্ছিল, করোনা তো পরে, না খেতে পেয়েই মারা যাব! যে চিকিৎসক আমায় ভর্তি করিয়েছিলেন তিনি দেখতে আসতেই তাঁকে বাড়ি যেতে চাই জানালাম। তিনি মুখের উপরে প্রেসক্রিপশন ছুড়ে দিলেন। আমার অক্সিজেন সাপোর্ট খুলে দিয়ে তখনই বার করে দিতে বললেন নার্সদের।

ছেলে তখন অত দূর থেকে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। খালি বলছে, একটু সহ্য করে নিতে। ছেলেকে বোঝালাম, এখানে থাকলে আমার চিকিৎসা হবে না। ছেলে শেষে রাজি হল। দেড় বেলার জন্য বিল হল ৩৩ হাজার টাকা!

হাসপাতাল থেকে ফেরার পরদিন সকালেই দেখছি, একেবারে শ্বাস নিতে পারছি না। এই ক’দিন আমার যে মাসতুতো দাদা খুব সাহায্য করেছিলেন, ওঁকে জানালাম, সুলেখা মোড়ের কাছে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার ভাড়া পাওয়ার দোকানের কথা। সেখানে দ্রুত গিয়ে অক্সিজেনের খোঁজ করতে বললাম। তত দিনে অক্সিজেন নিয়ে এক রকম হাহাকার শুরু হয়ে গিয়েছে। ওই দাদা জানালেন, দু’হাজার টাকা জমা রাখলে সিলিন্ডার পাওয়া যাবে। প্রতিদিনের ভাড়া এক হাজার টাকা। তাই নিয়েই বাড়িতে দিতে বললাম। শ্যামবাজারের হাসপাতালে থাকাকালীন কোন পরিস্থিতিতে কতটা অক্সিজেন দিচ্ছে, দেখে নিয়েছিলাম। সেইটা মনে করে নিজের মতো করে অক্সিজেন চালানো শুরু করলাম। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ১৭ দিনের মাথায় আমার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। স্বামী আর মাসতুতো দাদারও রিপোর্ট নেগেটিভ।

এখন ভাবি, ভাগ্যিস হাসপাতালের থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ছেলেও বুঝেছিল সে কথা। ছেলের এক বন্ধু যে ভাবে দিনের পর দিন সাহায্য করেছে, ভোলার নয়। আর ছিল আমার মনের জোর।

সকলকে বলতে চাই, কোনও পরিস্থিতিতেই ভয় পাওয়া চলবে না। আমি যদি পারি, সবাই পারবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

COVID-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE