দশমীর পরে গঙ্গার অবস্থা দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠেছিলেন এক পরিবেশবিদ। দেখেছিলেন, গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে কাঠামো। নদীর পাড়ে জমে রয়েছে পচা ফুল, মালা, প্রতিমার কাপড়! পরিস্থিতি বদলাতে শেষ পর্যন্ত আদালতে ছুটেছিলেন তিনি।
পুজোর সঙ্গে পরিবেশের এই দ্বন্দ্ব নতুন নয়। বিসর্জনের শোভাযাত্রায় শব্দবাজি, তারস্বরে সাউন্ড বক্স বাজানো নিয়েও আপত্তি রয়েছে পরিবেশকর্মীদের। আপত্তি রয়েছে প্রতিমার রং নিয়েও। আবার চমক দিতে দূষণের বিরুদ্ধে পুজোর থিম গড়াটাও শহরে নতুন কিছু নয়। পরিবেশবান্ধব উপকরণ হোক বা দূষণের বিরুদ্ধে জেহাদ, গত কয়েক বছরে নানা থিম দেখেছে মহানগর।
এ বারেও পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে থিম গড়েছেন অনেকে। তাঁদের কেউ কেউ আবার বকলমে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তোলারও ডাক দিচ্ছেন। কী ভাবে?
জিনগত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চ ফলনশীল গাছ বা প্রাণী তৈরির করার কথা নতুন কিছু নয়। যা নিয়ে রয়েছে বিতর্কও। রয়েছে পরিবেশকর্মীদের আন্দোলনও। এ বার সেই জিনপ্রযুক্তির ব্যবহারের বিতর্ককেই থিমে তুলে এনেছে টালা বারোয়ারি।
ছোটবেলায় পড়া সুকুমার রায়ের হাঁসজারু কিংবা বকচ্ছপকে মজার প্রাণী হিসেবেই চেনানো হয়। কিন্তু সেই মজার প্রাণীর পিছনে জিনপ্রযুক্তির আশঙ্কার কথাই বলা হয়েছিল বলে মনে করেন পরিবেশকর্মীদের একাংশ। জিনপ্রযুক্তির বিতর্ককে তুলে আনতে গিয়ে সুকুমার রায়কেই হাতিয়ার করেছে টালা বারোয়ারি। হাতিমি, বকচ্ছপের পাশাপাশি তাদের নতুন আবিষ্কার হাইব্রিডাসুর, চিকানোসোরাস। থিম সাজাতে গিয়ে শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যবহার করছেন টিন, লোহা, ইলেক্ট্রোফোম। মণ্ডপের মাঝে প্রকৃতির ধারক হিসেবে থাকছে গাছও। টালা বারোয়ারির পুজোকর্তা অভিষেক ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘জিনপ্রযুক্তির খাবার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতেই আমাদের এই থিম।’’
অনেকে অবশ্য বলছেন, জিনপ্রযুক্তি নিয়ে বোঝানো চাট্টিখানি কথা নয়। পাশাপাশি এই শহরের অন্যতম বড় সমস্যা বায়ুদূষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) একটি সমীক্ষায় কলকাতার বায়ুদূষণের মাত্রা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বলে জানানো হয়েছিল। তার ফলে এই শহরের বাসিন্দাদের হাঁপানি বা ফুসফুসের ক্যানসার বাড়তে পারে। তেমনই আর এক জ্বলন্ত সমস্যা বিশ্ব উষ্ণায়নও। যার জেরে বদল আসছে পৃথিবীর আবহাওয়া-জলবায়ুতেও। এবং পরিবেশবিদেরা বলছেন, এ সব সমস্যা আটকাতে নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ করাটাই প্রধান কাজ।
এ বার সেই গাছকে নিয়েই থিম সাজিয়েছে পার্ক সার্কাস সর্বজনীন। শিল্পী রিন্টু দাস সেখানে রাখছেন শিশুর মাথা থেকে বেরিয়ে আসা গাছ। মণ্ডপ চত্বরে থাকছে ‘রক্তাক্ত’ ডালপালাও। যেমন এ বার প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে বাংলার মাটির পুতুলকে থিম হিসেবে বেছেছে বেহালা বুড়োশিবতলা জনকল্যাণ সঙ্ঘ।
এ সব সত্ত্বেও পরিবেশকর্মীদের অনেকেই বলছেন, পরিবেশ নিয়ে যতই থিম গড়া হোক না কেন, মহানগরের পুজো কিন্তু এখনও দূষণের থেকে সরে আসতে পারেনি। রাজ্যের পরিবেশ দফতরের এক কর্তা বলছেন, দূষণ এড়াতে সিসামুক্ত রঙের প্রচার শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রচার কার্যত কাগজে আর হাতেগোনা কয়েক জন শিল্পীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছে। নামী শিল্পী কিংবা বড় ক্লাবগুলি সে দিকে ঘেঁষেনি। এ বছর অবশ্য পুজো ময়দানের নামী শিল্পী দীপক ঘোষ দক্ষিণ কলকাতার প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের পুজোয় সিসামুক্ত রং দিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু ওইটুকুই। নামী ক্লাবের কর্তা এবং নামী শিল্পীদের অনেকেই বলছেন, বাজারচলতি রঙে যে জেল্লা আসে তা সিসামুক্ত রঙে মেলে না। তাই বেশির ভাগই পরিবেশবান্ধব রং ব্যবহার করার দিকে ঝোঁকেন না। যেমন প্লাস্টিক দূষণের কথা জানলেও বহু পুজো মণ্ডপেই ভোগের প্যাকেট বিলির ক্ষেত্রে ক্যারিব্যাগ দেওয়া হয়। উত্তর কলকাতার একটি ক্লাব দর্শকদের মধ্যে জলের বোতল বিলি করে। দেখা যায়, বহু দর্শকই জল খেয়ে আশপাশের রাস্তায় ফেলে যান।
প্রশ্ন, পরিবেশ সচেতনতা কি শুধু তা হলে থিমেই আটকে থাকবে? সদু্ত্তর কিন্তু মিলছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy