Advertisement
E-Paper

যুদ্ধ-ধ্বস্ত স্বদেশের জন্য প্রার্থনা শহরের আর্মেনীয়দের

আর্মেনিয়ান অ্যাপস্টলিক বা অর্থোডক্স চার্চের মতে, ২৫ ডিসেম্বর দিনটা প্রাক্‌-খ্রিস্টীয় যুগের পার্বণ।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:২৩
আর্মেনিয়ান অ্যাপস্টলিক চার্চে প্রাক্‌-বড়দিনের প্রার্থনা। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র

আর্মেনিয়ান অ্যাপস্টলিক চার্চে প্রাক্‌-বড়দিনের প্রার্থনা। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র

বড়দিনের আগের সন্ধ্যা বলে কথা! মঙ্গলবার ছিল ২০২১-এর ‘ক্রিসমাস ইভ’। আর আজ, বুধবার হল নতুন বছরের বড়দিন। তবে পার্ক স্ট্রিট নয়, শহরের এই ক্রিসমাস পার্বণের কেন্দ্র হল বড়বাজার।

অতিমারির আবহেও বড়বাজার আছে বড়বাজারেই। হকারের ছাউনির জঙ্গল, মাকড়শার জালের মতো তারের জট ঠেলে ব্রেবোর্ন রোডের ধারের সর্পিল গলিটা খুঁজে পেতে শীতেও গায়ে ঘাম দেবে। ঠিক সেখানেই আলোর ঝালর গায়ে অপেক্ষমাণ কয়েক শতাব্দী আগের আর্মানি গির্জা। এখানেই কলকাতার প্রাচীনতম খ্রিস্টান উপাসনালয়। আঠারো শতকের গোড়ায় পথ চলা শুরু হয়েছিল এই ধবধবে সৌধের। এই তল্লাটেই শহরের গুটিকয়েক আর্মেনিয়ানের বড়দিন উদ্‌যাপনের কর্মকাণ্ড। তবে করোনাকাল এবং আজ়ারবাইজানের সঙ্গে যুদ্ধে জেরবার আর্মেনিয়ার রাজনৈতিক পরিবেশ— সব মিলিয়ে কলকাতার আর্মেনিয়ান ক্রিসমাস পরম্পরারও এ বার তাল কেটে গেল।

আর্মেনিয়ান অ্যাপস্টলিক বা অর্থোডক্স চার্চের মতে, ২৫ ডিসেম্বর দিনটা প্রাক্‌-খ্রিস্টীয় যুগের পার্বণ। সে দিন সূর্যের উপাসনা করতেন রোমানরা। এমনিতে বড়দিনের পরের দ্বাদশতম রজনীর শেষেই প্রাচ্যের তিন বৃদ্ধের কাছে ঈশ্বরপুত্র বলে চিহ্নিত হন জিশু। ৬ জানুয়ারি হল খ্রিস্টানদের কাছে ‘ফিস্ট অব এপিফ্যানি’। এই দিনটাই আর্মেনীয়রা ‘ক্রিসমাস’ পালন করেন। কলকাতার আর্মেনিয়ান ক্রিসমাসে এ বার ময়দানের আর্মেনিয়ান তাঁবুতে বচ্ছরকার চা-চক্র নেই। আর্মানি গির্জার জমায়েতটাও নামমাত্র। প্রাক্-বড়দিন সন্ধ্যায় গির্জায় দাঁড়িয়েই নিচু তারে বাঁধা উৎসবের কথা শোনাচ্ছিলেন গত দু’দশকের বেশি কলকাতার বাসিন্দা ভাচে তাদেভোসিয়ান।

ভাচে ও তাঁর স্ত্রী নারিনে লা মার্টিনিয়ার ফর বয়েজ় স্কুলের সঙ্গীত শিক্ষক। গির্জাতেও তাঁরাই অর্গ্যান, পিয়ানো বাজান। এই দু’জনকে ধরে আর্মেনিয়ান ‘চার্চ অব হোলি ন্যাজ়ারেথ’-এর প্রাক্-বড়দিন অনুষ্ঠানে সাকুল্যে ১৪ জনকে দেখা গেল। তা-ও প্রধানত বৃদ্ধ ভারতীয় আর্মেনীয়রা বেশির ভাগই আসেননি। বেসরকারি কলেজে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের পড়ুয়া, একুশের যুবা জ়াভেন গ্যাসপার বলছিলেন, ‘‘আর্মেনিয়ান কলেজের পড়ুয়ারা বেশির ভাগই ইরাক-ইরান বা আর্মেনিয়া থেকে আসেন। অতিমারির জন্য ফিরে গিয়েছেন। অন্য বার ওঁদের ভিড়টাই গির্জা মাতিয়ে রাখে।’’

এ দিনের প্রায় জনহীন গির্জা অবশ্য মাতিয়ে রাখল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের যাজক, ফাদার হাইকের পুঁচকে ছেলেটির দুরন্তপনা। কোলের ছেলেটিকে সামলে রাখতে সারা ক্ষণ চাকা লাগানো দোলনা ঠেলে ভোলাচ্ছিলেন মা। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রটির অতএব ভারি মজা। সারা গির্জা টো-টো করে কখনও পাদ্রীদের কোলে উঠছে, কখনও বা টেবিলে রাখা ধর্মগ্রন্থ পড়ার চেষ্টা করছে দস্যি দু’বছুরে। গুরুগম্ভীর পরিবেশে প্রার্থনা, অর্গ্যান, পিয়ানোর সুরের মাঝে এই শিশুটিরই নিজের মতো খেলার স্বাধীনতা থাকল।

যুদ্ধের পরিস্থিতিতে আর্মেনিয়ার রাজধানী এরেভান থেকে কলকাতায় ফেরা এখন খুবই কঠিন। কেউ জানেন না, কবে পুরনো ছন্দে ফিরবে সেই দেশ। জ়াভেনের মা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, বাবা আর্মেনীয়। তিনি হাসলেন, ‘‘সেই হিসেবে ২৫ ডিসেম্বর আর ৬ জানুয়ারি— দু’টি বড়দিনেই আমরা আনন্দ করি!’’ অনুষ্ঠানের আগে ভাচে গল্প শোনাচ্ছিলেন, তাঁদের ইলিশ আর ভেটকি-প্রীতির কথা। বড়দিনে অনেক আর্মানি পরিবারেই ভাপানো ভেটকি ও পিলাফ (পোলাও) হবে। বাঙালিরা আর্মেনীয়দের থেকেই দোলমা রান্না শিখেছেন, কলকাতার মাছও গুটিকয়েক আর্মানির খুব প্রিয়।

এই বড়দিনে আর্মেনীয়দের অনেকেরই মনে পড়ছে, এ শহরের ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধা সোনিয়া জনের কথা। গত সেপ্টেম্বরেই ৯৫ বছর বয়সে তিনি মারা গিয়েছেন। অতীতে ইতিহাসের বহু সঙ্কটে আর্মেনীয়দের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল এই কলকাতা। বিশ শতকের গোড়ায় তুর্কিদের হামলার সময়ে আর্মেনিয়ানরা অনেকেই ঢাকা-কলকাতায় ঘাঁটি গাড়েন। গ্র্যান্ড হোটেল, স্টিফেন কোর্ট-সহ কলকাতার বহু বাড়িতেই আর্মেনীয়দের শৌর্যের স্বাক্ষর। বড়দিনের আগে যুদ্ধধ্বস্ত মাতৃভূমির জন্যও ফাদার প্রার্থনা করলেন। সে যুগ কিংবা এ যুগে আর্মেনীয়দের কাছে কলকাতা আশ্রয়ের নিশ্চিন্তির ঠাঁই হয়েই থেকে গিয়েছে।

Armenia Festival
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy