Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
International Mother Tongue Day

ফেসবুকের বাংলা কি ভাষার মর্যাদাহানি করছে, বিতর্ক

‘ইংরেজি ভাষায় স্বপ্ন দেখলে সারা বিশ্বকে ছুঁতে পারবেন। কিন্তু বাংলা ভাষা দিয়ে কি সেটা সম্ভব?’

অনাদরে: ভাষা দিবসের আগের দিনও আগাছায় ঢাকা ভাষা স্মারক।  কার্জন পার্কে ভেঙে গিয়েছে গেটের বোর্ডও।

অনাদরে: ভাষা দিবসের আগের দিনও আগাছায় ঢাকা ভাষা স্মারক। কার্জন পার্কে ভেঙে গিয়েছে গেটের বোর্ডও। ছবি: সুদীপ্ত

দেবাশিস ঘড়াই
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:৪৯
Share: Save:

‘ইংরেজি ভাষায় স্বপ্ন দেখলে সারা বিশ্বকে ছুঁতে পারবেন। কিন্তু বাংলা ভাষা দিয়ে কি সেটা সম্ভব?’— বলছিলেন রাজ্যের সরকারি কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের এক অধ্যাপক।

প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগে বাংলা নিয়ে চর্চা হয়। আজ, রবিবার মাতৃভাষা দিবসে যেমনটা হচ্ছে। তবে এই সাময়িক চর্চায় বাংলা ভাষার যে কোনও উন্নতি হয়নি, তা এত দিনে পরিষ্কার। আর বাংলা ভাষার মানোন্নয়ন না হওয়ার পিছনে ফেসবুক-সহ সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা রয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে।

এক দলের বক্তব্য, ফেসবুকে লেখার তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে এর ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে মিথ্যে আত্মতুষ্টি তৈরি হয়। যেমন, লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, ফেসবুক-সহ সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন ঘরে ঘরে কবি-লেখক। সিংহভাগই পাঠযোগ্য নয়, এমন কিছু লিখে যাঁরা তুমুল হাততালি (এ ক্ষেত্রে লাইক) কুড়োচ্ছেন। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজের লেখা নিয়ে ভ্রম তৈরি হচ্ছে, যা তাঁকে নিখাদ বাংলা ভাষা থেকে ক্রমশ দূরে নিয়ে যাচ্ছে। স্মরণজিৎবাবুর মতে, ‘‘অথচ কোনও ছেলে বা মেয়ে ভাল লিখলে তা নিয়ে তেমন কোনও উত্তেজনা নেই। কারণ, অধিকাংশ পাঠকের সাহিত্যের রিফ্লেক্সই তৈরি হয়নি। ফেসবুকে অপাঠ্য কিছু লেখা ও পড়ার সুবাদে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ সেই বোধ লোপ পেয়েছে।’’

ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্যেরও বক্তব্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি সমান্তরাল বাংলা ভাষা তৈরি হচ্ছে। এটা ঠিক যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলে মুহূর্তে তা অনেকের কাছে পৌঁছে যায়। তাঁর কথায়, ‘‘এটা যুগপৎ ভাল ও মন্দ। মন্দ, কারণ, মাঝারি ও নিকৃষ্ট মানের রচনা জনপ্রিয় হয়ে যায়। পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে যা কাজের বটে। তবে তার সাহিত্যগুণ নিয়ে সংশয় থাকে।’’ যদিও কবি সুধীর দত্ত বলছেন, ‘‘ফেসবুক-সহ সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে তো অনেক গালাগালি, কুৎসা চলে। কিন্তু দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে এ-সব কিছুই থাকবে না। ফলে বাংলা ভাষা বিপন্ন, এই মতের একদমই পক্ষপাতী নই আমি।’’ মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র অধিকর্তা প্রদীপ সাহার মত, ‘‘অনেকেই ফেসবুকে পোস্টের মাধ্যমে নিজের গুরুত্ব বোঝাতে চান। প্রত্যাশা মতো লাইক না পেলে তখন তাঁদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। এটা ইংরেজি-বাংলা বা যে কোনও ভাষার ক্ষেত্রেই
সত্যি। ফলে কোন ভাষায় কী পোস্ট করছি, তার থেকেও কী মনোভাব নিয়ে পোস্ট করছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।’’ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি বারিদবরণ ঘোষ আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অবাঙালিরা যখন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল করছেন, তখন তাতে ভর্তি হওয়ার জন্য লাইন পড়ে যাচ্ছে। অথচ রাজ্য সরকারের তরফে যখন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল খোলা হয়, তখন সে ভাবে সাড়া পাওয়া যায় না।’’

আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তির সঙ্গে ভাষা-অর্থনীতি জড়িয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাক্রোইকনমিক্সের অধ্যাপক পরন্তপ বসু জানাচ্ছেন, অন্য অনেক ভাষার লেখকেরাই মাতৃভাষায় লেখেন। সেগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘বাংলা ভাষায় সেটা কেন হয় না, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কারণ, বাংলা সাহিত্যের এমন অনেক মণিমুক্তো রয়েছে, যা ইংরেজিতে অনুবাদ হলে তার বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে নিঃসন্দেহে। এ ক্ষেত্রে মনে হয় উদ্যোগের অভাব রয়েছে।’’

যেমন অভাব রয়েছে কত টাকার বাংলা বই বিক্রি হচ্ছে, সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যের। ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড’-এর তরফে জানানো হয়েছে, গত বছর বইমেলায় প্রায় ২০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু কত টাকার বাংলা বই বিক্রি হয়েছিল, সে সম্পর্কে তাঁদের কাছে কোনও তথ্য নেই বলে জানাচ্ছেন গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক সুধাংশুশেখর দে। তাঁর কথায়, ‘‘এ জন্য ভবিষ্যতে কোনও সংস্থা নিয়োগ করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে কত টাকার বাংলা বা ইংরেজি বই বিক্রি হচ্ছে, তার তথ্যভাণ্ডার রাখা সম্ভব হবে।’’ কলকাতা পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য তথা শিক্ষা দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘বিপিএল তালিকাভুক্ত মানুষেরাও চাইছেন তাঁদের সন্তানেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুক। তাই মাতৃভাষা বাংলাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই আমরা পুর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর বন্দোবস্ত করছি।’’

তথাকথিত ‘এলিট’ সম্প্রদায়ের ইংরেজির একাধিপত্য ফুৎকারে উড়িয়ে সমাজের প্রান্তিক মানুষেরাও এই ভাষায় কথা বলবেন, এমন স্বপ্ন অনেকেই দেখছেন। কিন্তু সেই স্বপ্নে মাতৃভাষা বাংলা থাকুক মন-শিকড়ের কাছাকাছি। আজ, রবিবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রত্যাশা এটুকুই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Language International Mother Tongue Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE