Advertisement
E-Paper

বাজত রেডিয়ো, সৃষ্টিসুখে কাঁদতেন বিরূপাক্ষ

মহালয়া ঘিরে দু’টি ঘটনা ঘটে সত্তরের দশকের সেই বছরটিতে। শোনা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই মহালয়ার সকালে সে বার আকাশবাণী ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র বদলে বাজিয়েছিল ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৪:৩২
পুরনো সেই: মহালয়ার আগে রেডিয়ো সারাতে ব্যস্ত এক প্রবীণ। মঙ্গলবার, কুমোরটুলিতে। ছবি: সুমন বল্লভ

পুরনো সেই: মহালয়ার আগে রেডিয়ো সারাতে ব্যস্ত এক প্রবীণ। মঙ্গলবার, কুমোরটুলিতে। ছবি: সুমন বল্লভ

আশ্বিনের শারদপ্রাতে উত্তর কলকাতার ৭, রামধন মিত্র লেনের বাড়িতে ঘনঘন বেজে উঠছিল টেলিফোন। প্রথম কণ্ঠ নাট্যকার মন্মথ রায়ের, “বীরেন, এটা কী হল?” এর পরে সারা দিন ফোনের বন্যা। উত্তর দেননি বিরূপাক্ষ। বাড়ির লোক বাধ্য হয়ে টেলিফোন নামিয়ে রাখেন।

মহালয়া ঘিরে দু’টি ঘটনা ঘটে সত্তরের দশকের সেই বছরটিতে। শোনা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই মহালয়ার সকালে সে বার আকাশবাণী ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র বদলে বাজিয়েছিল ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’। যেখানে মূল ভাষ্যপাঠ করেছিলেন উত্তমকুমার। সংলাপ বলায় পারদর্শী কণ্ঠ আর সুরেলা ভাষ্যপাঠের বিশেষ আবেদনের মধ্যে সে দিন তফাত খুঁজে পেয়েছিল বাঙালি। শ্রোতাদের চাপেই পাঁচ দিন পরে মহাষষ্ঠীর সকালে রেডিয়োয় বাজল ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির...।’ ইতিহাস ছুঁয়ে ফেললেন বিরূপাক্ষ, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বাঙালি যেন স্থির করে ফেলল, আজীবন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠের আলোর বেণুর সুরেই দেবীপক্ষের প্রথম প্রভাত মুখরিত হবে।

২০২০ সালের এই অতিমারির বাতাবরণে মঙ্গলবার সকালে তেতলার ঘরে বসে সেই কাহিনি শোনাচ্ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের নাতি সায়ম ভদ্র। বিজ্ঞাপন জগতের উচ্চপদস্থ কর্মী, ব্যস্ত ছিলেন ওয়ার্ক ফ্রম হোমে। তেতলায় পৌঁছতে হল ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি পেরিয়ে। পুরনো কলকাতার খড়খড়ির জানলা দিয়ে সিঁড়ির হাতলে ছিটকে পড়ছে শরতের রোদ। দোতলায় ওঠার পথে দেওয়ালে ঝুলছে বেলজিয়াম কাচের বিরাট আয়না।

সায়মবাবুর কথায়, “দাদুর সময়টা মনে করায় এই জিনিসগুলোই। ছেলের অন্নপ্রাশনে দাদুকে নিমন্ত্রণ করতে এই সিঁড়ি দিয়েই উঠেছিলেন উত্তমকুমার।” এক বার উত্তমকুমারকে চিনতে না পেরে বাড়ির নীচেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ছোট মেয়ে।

রেডিয়োর যুগ শেষ। তবু আজও মহালয়ায় ঘরে ঘরে সকাল শুরু হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সেই স্তোত্রপাঠ দিয়েই। সায়মবাবুর কথায়, “ডিজিটাল মিডিয়ায় যখন তখন মহালয়া শোনা যায়। কিন্তু মহালয়ার সকালে ওই স্তোত্রপাঠ শুনেই মনে হয় পুজো এসেছে।”

এ বার পুজো আসতে দেরি। বঙ্গীয় পুরোহিত সম্মিলনী ইতিমধ্যেই চেয়েছে মহালয়া ছাড়াও বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আরও এক দিন বাজাক আকাশবাণী। তা সম্ভব নয়, জানিয়ে দিয়েছে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র। বরং খবর, এ বার ষষ্ঠীতে উত্তমকুমারের পাঠ করা ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’ বাজানো হতে পারে।

যদিও রামধন মিত্র লেনের বাসিন্দাদের অনেকেই মনে করেন মহালয়ার সকাল কিংবা দুর্গাপুজোর স্তোত্রপাঠ মানে তাঁদেরই প্রতিবেশীর কণ্ঠ। প্রতি বছরই মহালয়ার আগে এই পাড়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর বাড়ির দিকে তাকিয়ে স্মৃতিকারত হয়ে ওঠেন প্রবীণদের অনেকেই। সরু গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর বাড়ির সামনে থেমে গেলেন এক প্রৌঢ়। “একটা এমন কণ্ঠ, যাঁর অনুকরণ করা যায় না। বাবার মুখে শুনেছি মহালয়ার সকালে গঙ্গাস্নান সেরে শুদ্ধবস্ত্র পরে রেডিয়োয় পাঠ করতে যেতেন।”― বললেন প্রৌঢ়।

এমন অনেক গল্পের সাক্ষী রামধন মিত্র লেন। আরও গল্প শোনা গেল সেই বাড়িতে বসে। আকাশবাণীর কর্মী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যে কোনও ধরনের পাঠ করতে পারতেন। কিন্তু সবই যদি এক নামে পাঠ করেন, শ্রোতা তো একঘেয়েমিতে ভুগতে পারেন। তাই তিনি একাধিক ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। তবে বিরূপাক্ষ নাম ছিল বেশি প্রচলিত।

মহালয়ার সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সঙ্গে রেডিয়োর মহিষাসুরমর্দিনী শোনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নাতি বলেন, “এমনও দেখেছি, দাদু রেডিয়োয় নিজের পাঠ শুনছেন। আর চোখ দিয়ে জলধারা নেমে আসছে। মহিষাসুরমর্দিনী রেকর্ডের পরে বহু অনুষ্ঠানে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গানের সঙ্গে স্তোত্র পাঠ করতেন দাদু।” শেষ জীবনে অবশ্য স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।

এই ধারা পরিবার ধরে রাখতে পারল না?

সায়মবাবুর আফশোস, “বাবা চাইলে হয়তো পারতেন। তখনও স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো হত। আমরা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করায় দাদুর ঘরানা ধরে রাখতে পারিনি। ধরে রাখা উচিত ছিল।”

ঘরানা নেই ঠিকই, তবু মহালয়ার শারদপ্রাতের আগে সেই কণ্ঠের মোহেই আজও ঘন ঘন পায়ের শব্দ শোনে ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি।

Bireandra Krishna Bhadra Mahalaya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy