তিন দশকেরও বামফ্রন্টের হাতে থাকা বাংলায় রাজনৈতিক ‘পরিবর্তন’ আনার চূড়ান্ত যাত্রা সিঙ্গুর থেকেই শুরু করেছিলেন মমতা। তার পরে আসে নন্দীগ্রাম। সম্প্রতি নন্দীগ্রামে সে কথা মনেও করিয়ে দিয়েছেন মমতা। সেই প্রেক্ষিতে তৃণমূলের কাছে সিঙ্গুর মানে একটি বিধানসভা আসন নয়, সিঙ্গুরের আন্দোলন থেকে গোটা রাজ্যের কাছে কৃষি ও কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা। এ বার বিধানসভা ভোটের আগে মমতার সেই রাজনীতিকে ‘ভুল’ বলে প্রমাণ করতে মরিয়া বিজেপি।
গত লোকসভা নির্বাচনে হুগলি আসনে লকেটের জয়ে অনেকটাই অবদান ছিল সিঙ্গুরের। এককালে বামেদের ‘দুর্গ’ হুগলি আসনে ৭ বার জেতা সিপিএম প্রার্থী রূপচাঁদ পাল ২০০৪ সালের নির্বাচনেও পেয়ছিলেন ৫৪ শতাংশ ভোট। এর পরে ২০০৯ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে জেতেন তৃণমূলের রত্না দে নাগ জেতেন। দু’বারই তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপির উত্থান হয় ২০১৯-এর নির্বাচনে। ৭২ হাজারেও বেশি ব্যবধানে জেতেন লকেট। এর মধ্যে সিঙ্গুর বিধানসভা এলাকা থেকেই তিনি এগিয়েছিলেন ১০ হাজারের বেশি ভোটে।
লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই বিধানসভার প্রস্তুতি শুরু করেছিল বিজেপি। লকেটের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সিঙ্গুর। গত কয়েক মাসে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সেখানে কোনও না কোনও কর্মসূচি করেছেন তিনি। এমনকি, সিঙ্গুরে রাত্রিবাস করেও নিজেকে ‘ঘরের মেয়ে’ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন লকেট। দিনের পর দিন কৃষকদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছেন। পাড়ায় পাড়ায় মাঠে বসে ‘চাটাই বৈঠক’ করেছেন। যার নাম ‘শুনুন চাষিভাই’। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘সিঙ্গুরে কৃষির পাশাপাশি শিল্পও চাই। তেমনই টাটাদেরও চাই। কারণ, ওঁরা এখান থেকে ফিরে গিয়েছেন।’’ বিজেপি সূত্রের খবর, এর পুরোটাই অমিতের পরামর্শ ও নির্দেশমতো। সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই গত ২ জানুয়ারি সিঙ্গুরে মুকুলকে নিয়ে সভা করেন লকেট। যেখানে গিয়ে মুকুল বলেন, ‘‘সিঙ্গুরের মাটিতে এলে পাপবোধ জন্মায়। যে ভাবে আন্দোলন করে টাটাকে তাড়ানো হয়েছিল, তাতে সারা ভারত বাংলা সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল। তাই পাপবোধ জন্ম নেয়। অন্যায় হয়েছিল। ভুল করেছিলাম।’’ ক্ষমতায় এলে সিঙ্গুরে শিল্প স্থাপনের আশ্বাসও দেন মুকুল। ৮ জানুয়ারি নন্দীগ্রামে গিয়েও দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারীদের পাশে নিয়ে মুকুল বলেন, সিঙ্গুরে টাটাকে ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবার করবেন তাঁরা।
বিজেপি-র ওই চেষ্টা আঁচ করেই মমতা ঘোষণা করেছিলেন, সিঙ্গুরের প্রাকৃতিক চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেখানে অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক গড়ে উঠবে। সিঙ্গুর রেলস্টেশনের কাছে ১১ একর জমিতে কাজ হবে। জানান, ওই পার্ক গড়তে কারও থেকে কোনও জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। যে প্রসঙ্গে লকেট বলছেন, ‘‘২০১১ সালে সিঙ্গুরে যখন টাটার কারখানা তৈরির কাজ ৯৫ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল, তখন উনি ওদের বিদায় দিয়েছিলেন। এখন জমিটার এমন অবস্থা, যে আর কৃষিও হবে না। এখন ভোটের সময় তাঁর হঠাৎ সিঙ্গুরের কথা মনে পড়ল!”
লকেট জানিয়েছেন, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সিঙ্গুরে শিল্প ফেরাতে দরবার করবেন তো বটেই, অমিতকেও সিঙ্গুরে আসতে অনুরোধ করবেন। লকেটের কথায়, ‘‘আমরা চাই এখান থেকে শুরু করে রাজ্যের সর্বত্র শিল্পায়ন হোক। বাংলায় ডবল ইঞ্জিন সরকার হলেই সেটা সম্ভব। সিঙ্গুর শুধু একটা বিধানসভা আসন নয়। এই রাজ্যে কৃষি বনাম শিল্পের বিবাদের জন্মস্থান। বিজেপি দুইয়ের সহাবস্থান চায়। সিঙ্গুর তার প্রতীক হবে।’’
তৃণমূলের হুগলি জেলা সভাপতি দিলীপ যাদবের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘সিঙ্গুর আর মমতা'দির নাম সমার্থক। তিনি সিঙ্গুরে গিয়ে দাঁড়ালে মানুষ তাঁকে কাছে টেনে নেবে।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে কোনও শাহ, মোদী ছিলেন না। ওটা মমতার জমি। তৃণমূলের জমি। ছিল, আছে, থাকবে।’’ তবে সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য, ‘‘বিজেপি যদি শিল্প আনতে চায় আনুক না। তাতে তো ভালই হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূল তখনও শিল্পের বিরুদ্ধে ছিল না। এখনও নেই। শুধু টাটা কেন, ইচ্ছুক কৃষকদের জমিতে যে কেউ শিল্প করতে এলে তাঁকে স্বাগত।’’