Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Bow Barracks

উৎসবে কাটছাঁট সব রঙে রং মেশানো বো ব্যারাকে

করোনা-কালের বড়দিনে এ পাড়ার চিরকালীন জমজমাট চেহারা এ বার ফিকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বচ্ছরকার সব অনুষ্ঠানই নিচু তারে বাঁধা।

ম্লান: করোনা পরিস্থিতিতে বড়দিনেও প্রায় ফাঁকা বো ব্যারাক। বাসিন্দারা উদ্যাপন সেরেছেন নিজেদের বাড়িতেই। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র

ম্লান: করোনা পরিস্থিতিতে বড়দিনেও প্রায় ফাঁকা বো ব্যারাক। বাসিন্দারা উদ্যাপন সেরেছেন নিজেদের বাড়িতেই। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০৩:৫১
Share: Save:

পোদ্দার কোর্টের পারিবারিক চিনে ইটিং হাউসের কর্ণধার কুচি চোইয়ের পরিবারের থেকে বো ব্যারাকের একতলার ফ্ল্যাটটি কিনে নিয়েছেন মধ্য কলকাতার পুরনো বাসিন্দা মহম্মদ আলাউদ্দিনের জামাই রমেশ সিংহ। শুক্রবার, বড়দিনের বিকেলে মেয়ে-জামাই ক্যারেন-রমেশদের বাড়ির বারান্দায় বসেই জমে উঠল তাঁর ক্রিসমাস-যাপন। আলাউদ্দিন সাহেব বলছিলেন, ‘‘আমাদের বাড়িটা বেশ মজার! আমার স্ত্রী খ্রিস্টান ঘরের মেয়ে। কন্যে আবার হিন্দু রাজপুতকে বিয়ে করল। এই তল্লাটটা এক্কেবারে ‘মিনি ইন্ডিয়া’! আমাদের মতো বহু পাঁচমিশেলি পরিবারেরই ছড়াছড়ি।’’

করোনা-কালের বড়দিনে এ পাড়ার চিরকালীন জমজমাট চেহারা এ বার ফিকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বচ্ছরকার সব অনুষ্ঠানই নিচু তারে বাঁধা। তবু আলোর ছবি তুলতে আসা আগন্তুকদের ভিড়টা একেবারে বাদ পড়েনি। উৎসবের আয়োজনে অনেক কিছুর ফাঁক থাকলেও সবার রঙে রং মেশানোর আবহমান সুরটুকু অটুট। ‘‘আসল কষ্টটা অন্য জায়গায়। আমারই তো ঠাকুরমা, পিসি সব কানাডায় পড়ে। ভিডিয়ো কলে কথা বলাই ভরসা! অতিমারির জন্যই নেই অনেকেই। কাদের নিয়ে হই-হুল্লোড় করব বলুন!’’— বলছিলেন, হো চি মিন সরণির হোটেলের পেশাদার ডিজে জ়েভিয়ার ন্যাথানিয়েল। চিনা-অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের মেয়ে, ঘরোয়া ওয়াইন তৈরিতে তুখোড় অ্যানা চাওয়ের ছেলেও দুবাই থেকে আসতে পারেননি।

ধানবাদের আইআইটি-তে পড়ানোর চাকরি নিয়ে সাত বছর পরে দেশে ফেরা বেলঘরিয়ার মধুমন্তী ভট্টাচার্য তাঁর মা, পিসি, সেজকাকাকে নিয়ে রঙিন কলকাতার ধুলো মাখতে চলে এসেছেন। বড়দিন ও নতুন বছরের শুভেচ্ছা-বার্তায় মোড়া দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফোনে ছবি তুললেন। বললেন, ‘‘মা, পিসিরা বাড়িতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। তাই গাড়িতে নিয়ে এসেছি। একটু ঘুরেই চলে যাব।’’ উত্তর কলকাতার সরোজিনী নায়ডু কলেজের পড়ুয়াদের ঝাঁকটাও বড়দিনে এ পাড়ায় এসেছে করোনা যুগে নিজেদের থমকে যাওয়া কলেজ-জীবনের স্বাদটুকু চেটেপুটে নিতে। জ়েভিয়ার আর তাঁর বন্ধু জন সিংহ এই দলটাকে আনন্দ দিতেই বিকেলে হঠাৎ তারস্বরে ডিজে বক্স চালিয়ে দিলেন। সেনেগাল, নাইজিরিয়ার ‘অ্যাফ্রো বিটস’ বাজছে লাল টুকটুকে বাড়ি-ঘেরা সাবেক মহল্লার উঠোনে। মাথার উপরে সুদৃশ্য চিনে লণ্ঠনখচিত আলোর সাজ। বড়দিনের আমেজ বলতে এটুকুই। অন্য বার জিশুর জন্মের দৃশ্যের প্রকাণ্ড মডেল দুগ্গাপুজোর মণ্ডপের মতো লাগে। এ বার সেটাই একেবারে ছোট মডেলে তুলে ধরা হয়েছে। বো ব্যারাকের উঠোনের মাঝখানে একটি ‘ক্রিসমাস ট্রি’ সেজেছে। সেটাই বিক্ষিপ্ত আগন্তুকের নিজস্বী বা ‘সেলফি-স্পট’।

বো ব্যারাকের বাসিন্দাদের সমিতির সেক্রেটারি এঞ্জেলা গোবিন্দরাজ কথা বলছিলেন, তাঁর দোতলার ফ্ল্যাটে বসে। বললেন, ‘‘সব কিছুই হচ্ছে নমো-নমো করে। ক্রিসমাসের আগের দিন ছোটদের পার্টি ছিল। বাতিল করে বাড়ি বাড়ি উপহারের ঝুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। রবিবার বুড়োবুড়িদের হাউজ়ি পার্টিও বন্ধ। ওঁদেরও ঘরে-ঘরে উপহার পাঠিয়ে দেব।’’ এঞ্জেলা জানাচ্ছেন, বৌবাজারের গির্জার হলে বর্ষবরণের পার্টিও এ বার হবে না। তবে ঘরোয়া ওয়াইন, ছানার কেকটেকের খোঁজে চেনা আন্টিদের ঠিকানায় কড়া নাড়ছেন গুটিকয়েক আগন্তুক। বড়ুয়াদের কনফেকশনারির মরসুমি চিলতে দোকানটিও খুলেছে। রতন বড়ুয়া বললেন, ‘‘বো ব্যারাকে লোক কম, পিকনিক গার্ডেন, ট্যাংরার অনেক বাঁধা খদ্দের আসতে পারছেন না। তবু প্লাম কেক, ছানার কেকের বাজার একেবারে খারাপ নয়। হুজুগে কলকাতাই বাঁচিয়ে রেখেছে।’’

সন্ধ্যার মুখে টালিগঞ্জ থেকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলেন গ্যাভিন ভট্টাচার্য। তাঁর মা এ পাড়ায় জন্মেছেন। বাবা তরুণ ভট্টাচার্য বিয়ে হওয়া ইস্তক এখানে থাকেন। বাড়ি বলতে বো ব্যারাকের এই মহল্লাকেই নিজের মনে হয় গ্যাভিনের। করোনা-কালের নানা ফাঁকেও কিছু টুকরো মিলনমেলার স্বাদেই অনেক অপ্রাপ্তি ভরাট করে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bow Barracks Christmas Day Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE