চলতি শতকের বয়স সবে তখন এক বছর। পাড়ার একটি ছেলেকে থিম পুজোর মণ্ডপ গড়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন পোস্তা দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের পুজোকর্তারা। গোবর দিয়ে তৈরি সেই মণ্ডপ দেখতে উপচে পড়েছিল ভিড়। সেই ভিড়ই বুঝিয়ে দিয়েছিল উৎসব-কাপের ময়দানে নতুন তারকা হতে চলেছেন প্রশান্ত পাল নামে সেই শিল্পী।
প্রশান্ত এখন পুজোর শিল্পীদের মধ্যে প্রথম সারিতে। কিন্তু দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের পুজোর জৌলুস ততটা আর নেই। অনেকটা একই অবস্থা পিকনিক গার্ডেনের সুনীলনগর সর্বজনীনের। পুজোর ময়দানে যার তুলনা করা হয় গড়ের মাঠের উয়াড়ি, খিদিরপুর, বালি প্রতিভার সঙ্গে। সাত-আটের দশকে যেমন এই ক্লাবগুলি তারকা ফুটবলার তৈরি করত, তেমনই সুনীলনগরও বছর বছর তরুণ পুজো-শিল্পী জুগিয়েছে।
১৯৯২-এ সুনীলনগরে পাটকাঠির মণ্ডপ গড়ে তাক লাগিয়েছিলেন তরুণ শিল্পী বন্দন রাহা। সেই শুরু। ক্রমে পুজোর ময়দানে বন্দন হয়ে ওঠেন তারকা। শুধু বন্দন নন, সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ দে-র মতো অনেক শিল্পীকেই তুলে এনেছে সুনীলনগর। কিন্তু ময়দানে খেলোয়াড় তুলে আনা ক্লাবগুলির যা হাল, একই হাল তাদেরও। সামর্থ্য না থাকায় বড় শিল্পী-জৌলুস ধরে রাখতে পারেনি।
এক সময়ে ভবানীপুরের পুজোর ভিড় অনেকটাই টেনে নিত সঙ্ঘমিত্র, মুক্তদলের মতো ক্লাব। কিন্তু সময়ের সঙ্গে নিজেদের বদলাতে পারেনি তারা। ফলে অতীতকে সঙ্গে নিয়েই পুজোর ময়দানে টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছে তাঁরা। আবার থিম পুজোর গোড়ার দিকে যেমন উঠে এসেছিল পদ্মপুকুরের ভবানীপুর দুর্গোৎসব সমিতি। বাতানুকূল মণ্ডপ গড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ক্রমে পুজোকর্তাদের অনেকেই সরে গিয়েছেন। কমেছে জৌলুসও। পুজো ময়দানের প্রবীণেরা অবশ্য স্বীকার করেন, কাঁথি, বাঁকুড়া থেকে যে সব লোকশিল্পের কারিগরদের ওই পুজোর কর্তারা কলকাতায় এনেছিলেন, তাঁরাই ক্রমে অন্য ক্লাবের হয়ে উৎসব-কাপ জমিয়ে দিয়েছেন। পদ্মপুকুরের ওই পুজোর আগেও বাতানুকূল মণ্ডপ গড়েছিল শিয়ালদহের রেলওয়ে অ্যাথলেটিক্স। স্টেশন লাগোয়া মাঠে পুজোর অবস্থানগত সৌজন্যে ভিড়টা একেবারে না কমলেও পুজোর জৌলুস অনেক কম। পুজো ময়দানের অনেকেই বলছেন, রেল ইউনিয়নের নেতা প্রদীপ ঘোষের হাত ধরেই শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল এই পুজোর। তিনি প্রয়াত হওয়ায় জৌলুসে ভাটা আসতে শুরু হয়েছিল।
এমন ভাবেই শহর থেকে হারিয়ে গিয়েছে অনেক পুজো, কোনও পুজো আবার জৌলুস হারিয়েও টিকে থাকার লড়াইয়ে রয়েছে। বছর চারেক আগেই চমকে দিয়েছিল সিঁথি ইউথ অ্যাথলেটিক। কিন্তু কোনও ‘অজানা’ কারণে তার জৌলুস এখন প্রায় নেই বললেই চলে। বেহালার জনকল্যাণের মণ্ডপ এক সময়ে ভিড়ে উপচে পড়ত। পিছিয়ে পড়েছে সেই পুজোও। কালীঘাটের সঙ্ঘশ্রীর পুজো লোকের মুখে মুখে ফিরত। গত কয়েক বছর ধরে থিম পুজোয় মেতেছে তারা। ভিড় হচ্ছে না এমনও নয়। তবুও সঙ্ঘশ্রী যেন ঠিক তেমনটা নেই, বলছেন অনেকেই।
জৌলুস কমেছে আদি বালিগঞ্জেরও। অথচ নয়ের দশকে বড় হয়ে ওঠা যুবকেরা এখনও এই পুজোর নস্ট্যালজিয়ায় আচ্ছন্ন। ওই সময়ে কৈশোর থেকে যুবক হয়ে ওঠা এক গায়কের গানেও ‘আদি বালিগঞ্জ’ রয়েছে। যেমন রয়েছে বাবুবাগান। এক সময়ে শহর কাঁপানো এই পুজোর দায়িত্ব পরিবর্তনের জমানায় হাতবদল হয়েছে। এক বছর সাধারণ পুজো করে ফের থিমে ফিরেছেন তাঁরা। কিন্তু সেই পুরনো দাপট কি আছে? অনেকের মনেই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। রামলালবাজার, নাকতলা সম্মিলনী, বাঁশদ্রোণী রায়নগরের পুজোও পিছিয়ে পড়ার তালিকায়। প্রায় থিতিয়ে গিয়েও নতুন করে শিল্পীর হাত ধরে ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে রূপচাঁদ মুখার্জি লেন।
পুজো উদ্যোক্তারা বলছেন, ভাঁড়ারে টানটাই প্রধান কারণ। এই পুজোগুলিতে নামী নেতা-মন্ত্রী-সংগঠকেরা নেই, তাই ‘স্পনসর’ পেতে কালঘাম ছুটে যায় তাঁদের। ফলে টান পড়ে ভাঁড়ারেও। যেমন এ বার ৫০ বছর পূর্তি ছিল দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের। কিন্তু সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে যেমন জাঁকজমক দেখা যায়, এখনও ততটা করে উঠতে পারেননি পুজো-কর্তারা। তাদের এক কর্তা বলছেন, ‘‘পুজোর সঙ্গে রাজনীতিতে না জড়াতে পেরে পিছিয়ে পড়ছি আমরা।’’ এমনই এক পুজোকর্তা বলছেন, ‘‘কোনও শিল্পীকে হয়তো আমরাই তুলেছি। কিন্তু এখন পেশাদার হয়ে গিয়ে তিনি আর কম বাজেটে কাজ করতে চান না।’’
তবে এই জৌলুস হারিয়েও মানুষের ভালবাসায় টিকে আছে পুজোগুলি। নব্বইয়ের দশকের ‘যুবা’রা আজও ঘুরতে বেরিয়ে সুনীলনগর, সঙ্ঘশ্রীর পুজো দেখবেনই। এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে দর্পনারায়ণের পুজোকর্তা বিকাশ দে-রও। তিনি বলছেন, ‘‘জৌলুস কমলেও এখনও বহু মানুষ আমাদের মণ্ডপে আসেন।’’ ভরা আকালে ওই ভালবাসাটুকুই তো পাওনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy