Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ক্যানসারকে হারিয়ে অটুট জীবনের ছন্দ

সুভাষিণী কথা বলতে পারত না। সেই ব্যর্থতা, তাঁর থেকে বড় বেশি কষ্ট দিত তাঁর মাকে। রবি ঠাকুর বলে গিয়েছিলেন, মেয়ের না পারাটা মায়ের জন্য বেশি যন্ত্রণার কারণ, কন্যার সাফল্য-ব্যর্থতাতেই লুকিয়ে থাকে মায়ের জয়-পরাজয়। অণিমা-অনুষ্কার জীবটাও এক মা-মেয়ের লড়াইয়ের গল্প।

ক্যানসার জয়ীদের অনুষ্ঠান। কলামন্দিরে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

ক্যানসার জয়ীদের অনুষ্ঠান। কলামন্দিরে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:৩৪
Share: Save:

সুভাষিণী কথা বলতে পারত না। সেই ব্যর্থতা, তাঁর থেকে বড় বেশি কষ্ট দিত তাঁর মাকে। রবি ঠাকুর বলে গিয়েছিলেন, মেয়ের না পারাটা মায়ের জন্য বেশি যন্ত্রণার কারণ, কন্যার সাফল্য-ব্যর্থতাতেই লুকিয়ে থাকে মায়ের জয়-পরাজয়।

অণিমা-অনুষ্কার জীবটাও এক মা-মেয়ের লড়াইয়ের গল্প। বিয়ের দু’বছর পরে যখন অনুষ্কা তাঁর জীবনে এল তখনই তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন নিজের সব অধরা ইচ্ছেগুলো ডানা মেলবে তাঁর মেয়ের জীবনে। কিন্তু স্বপ্নের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল এক মারাত্মক ব্যাধি, যার নাম লিউকেমিয়া। মেয়ের তখন মাত্র আঠেরো মাস, ডাক্তার অণিমাদেবীকে ক্যানসারের ব্যাপারে জানালেন। এক লহমায় কালো মেঘ ঢেকে দিল রঙিন আকাশ। হাওড়ার সালকিয়ার অণিমা দে ভাবলেন নাচের ছন্দে মেতে ওঠা অনুষ্কার পা দু’টো তাঁর আর দেখে যাওয়া হবে না। কিন্তু সেই আশঙ্কাকে বিজ্ঞান হারিয়ে দিল। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে তিনি এখন সুস্থ।

‘ক্যানসার সারভাইভার ডে’ উপলক্ষ্যে সম্প্রতি ক্যানসার যুদ্ধে জয়ীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল নেতাজি ক্যানসার রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সেখানে গান-নাচ-আবৃত্তিতে মেতেছিলেন তাঁরা। মঞ্চ আলো করল অনুষ্কার ভারতনাট্যমও।

এই মারণ রোগে লড়াইয়ে ইচ্ছেশক্তি আর আশপাশের মানুষের ভালবাসা ওষুধের মতোই সমান শক্তিশালী হাতিয়ার বলে জানাচ্ছেন মৌসুমী পাল। বারো বছর বয়সে তাঁর ওভারিয়ান ক্যানসার ধরা পড়েছিল। কৈশোর কেটেছে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তিনি এখন চব্বিশ, সম্পূর্ণ সুস্থ তরুণী। অনুষ্ঠানে নাচের আনন্দে বুঝিয়ে দিলেন, লড়াইটা কঠিন হলেও পাশের মানুষের ভালবাসায় তা সহজ হয়ে যায়।

অণিমা, মৌসুমী যুদ্ধ বোঝেন, লড়াইয়ের মানে জানেন। কিন্তু সংযুক্তা জানে না। বোঝার বয়স হয়নি। তবুও ও যুদ্ধ চালাচ্ছে। লড়ছে থ্যালাসেমিয়ার সঙ্গে। অন্যরা যেমন নিজেদের লড়াইয়ের কথা শোনাতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছিলেন, তেমনই নাচের শেষে ভিজল সংযুক্তার চোখ। তবে কারণটা ছিল ভিন্ন। নাচের শেষে ছ’বছরের ছোট্ট মেয়েটা কেঁদে ফেলে বলল, ‘ধুত্তোরি! দেখলে তো মা সেই স্টেপটা আবার ভুলে গেলাম।’ কথাটা শুনে সকলেই হেসে ফেললেন। ছোট্ট লড়াকু মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলেন আয়োজকদের এক জন। এত হাসি-আনন্দের মাঝে সংযুক্তার মায়ের চোখের কোণটা নোনা জলে ভিজে গেল।

মৌসুমী, সংযুক্তা, অণিমাদেবীর সঙ্গে হাজির ছিলেন তাঁদের সহযোদ্ধারাও। যাঁরা কেউ তাঁদের বাল্যবন্ধু হন, কেউ আবার অভিভাবক। হাসপাতালের ডিরেক্টর চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ক্যানসার সেরে যাওয়ার পরে যে কেউ আর পাঁচটা সুস্থ মানুষের মতোই জীবন যাপন করতে পারেন, তা বুঝতে শেখা খুব দরকার।’’

চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, সারা বিশ্বের মোট ক্যানসার রোগীর দশ ভাগের এক ভাগ ভারতীয়। এ রাজ্যেও প্রতি বছর বহু মানুষ নতুন ভাবে ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নতির জেরে কর্কট রোগ থেকে মুক্তির রাস্তাও মিলছে। কিন্তু এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে ওষুধের সঙ্গে সবচেয়ে জরুরি পথ্য হল বেঁচে থাকার ইচ্ছে, মনের জোর। তাই এই লড়াইয়ে জয়ীদের চোখের সামনে দেখলে অনেকেই জীবন যুদ্ধে অনুপ্রেরণা পাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kala mandir Cancer Patients Dance Performance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE