Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

‘গাড়িই ওকে শেষ করে দিল’

সোমবার দুপুরে শিবাজীর মৃতদেহ পৌঁছয় তাঁর বাড়িতে। বাড়ির একতলায় তাঁদের স্যানিটারি সামগ্রীর শোরুমে রাখা হয় মৃতদেহ।

শোকার্ত: শিবাজী রায়ের মৃতদেহের সামনে স্ত্রী নমিতা ও ছেলে শ্রেয়াংশ। সোমবার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে।

শোকার্ত: শিবাজী রায়ের মৃতদেহের সামনে স্ত্রী নমিতা ও ছেলে শ্রেয়াংশ। সোমবার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে।

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৮ ০২:৪৭
Share: Save:

রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে এম এল রায় হাউসের চারতলায় দেওয়াল জুড়ে লাগানো বা়ড়ির বড় ছেলে শিবাজী রায়ের ছবি। বিদেশি গাড়ির সামনে রোদ-চশমা পরে দাঁড়ানো কালো ফ্রেমে বাঁধানো শিবাজীর সেই ছবির নীচে লেখা, ‘লিভ ফর ড্রাইভিং, অন দ্য ওয়ে টু জার্মানি!’

রবিবার সন্ধ্যায় স্বামীর মৃত্যুর খবর বাড়িতে আসতেই দেওয়াল থেকে ছবিটা নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন শিবাজীর স্ত্রী নমিতা। আপাতত সেই ছবি ভাঁড়ার ঘরে প্যাকিং বাক্সে বন্দি। মঙ্গলবার সেই ছবির প্রসঙ্গ উঠতেই স্বামীর মৃতদেহ আঁক়ড়ে নমিতা বলেন, ‘‘গাড়িই ওকে শেষ করে দিল! একটাও গাড়ি আর যেন না থাকে। সব বিক্রি করে দিক। কোনও গাড়ির ছবিও চাই না।’’ পাশে বসা শিবাজীর মা বলেন, ‘‘আমার ছেলে তো কখনও খারাপ ভাবে গাড়ি চালায় না। কেন এ রকম হল? ছবি সরিয়ে আর কী হবে? ছেলেটা ফিরবে কি!’’

রবিবার সকালে বন্ধুদের সঙ্গে ছেলে শ্রেয়াংশকে নিয়ে ‘লং ড্রাইভে’ বেরিয়ে ডোমজুড়ের পাকুড়িয়া সেতুর কাছে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে শিবাজীর। যদিও বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছেন শ্রেয়াংশ। দুর্ঘটনার আগে তিনি নিজেদের গাড়ি থেকে নেমে বাবার বন্ধু আদর্শ সুরানার গাড়িতে ওঠেন। তার জায়গায় শিবাজীর গাড়িতে বসেন আদর্শের কন্যা আসনা। বছর আঠেরোর আসনা গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সোমবার দুপুরে শিবাজীর মৃতদেহ পৌঁছয় তাঁর বাড়িতে। বাড়ির একতলায় তাঁদের স্যানিটারি সামগ্রীর শোরুমে রাখা হয় মৃতদেহ। সেখানে ছেলের দেহের সামনেই একের পর এক স্যানিটারি সামগ্রী তুলে মুছে মুছে রাখতে দেখা যায় শিবাজীর মাকে। তিনি বলতে থাকেন, ‘‘আমাদের ছোট্ট ব্যবসা ছিল। বাবুই (শিবাজী) সেটাকে এত বড় করেছে। সব ওর পছন্দে কেনা। সব সময়ে নিয়ম মেনে গাড়ি চালাত। কেউ তা আর মনে রাখবে না।’’ শিবাজীর স্ত্রী নমিতা বলেন, ‘‘আবার গাড়ি কিনবে ভেবেছিল। আর সেই সুযোগটাই পেল না!’’

সস্ত্রীক শিবাজী।

রায় পরিবারের সদস্যেরা জানাচ্ছেন, শিবাজীরা দুই ভাই। তিনি এবং ছোট ভাই শুভদীপ দু’জনেই স্যানিটারি সামগ্রীর ব্যবসা সামলান। শিবাজী এবং নমিতার একমাত্র ছেলে শ্রেয়াংশ। এ বছরই সিবিএসই-র দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সে। পরিবার সূত্রের খবর, বাবার মৃত্যুর পর থেকে পারিবারিক স্যানিটারি সামগ্রীর ব্যবসার ভার নিয়েছিলেন বাড়ির বড় ছেলে শিবাজী। গত কয়েক বছরে আরও বেশ কয়েকটি ব্যবসাও শুরু করেছিলেন তিনি। ব্যবসার পাশাপাশি শিবাজীর অন্যতম শখ দামি গাড়ি। শিবাজীর বন্ধুরা জানাচ্ছেন, শিবাজীর গ্যারাজে ১৩টি গাড়ি রয়েছে। তার মধ্যে ৯টি দামি বিলাসবহুল বিদেশি গাড়ি। রয়েছে বেশ কয়েকটি দামি মোটরবাইকও।

গাড়ির প্রতি টান থেকেই সমমনস্ক কয়েক জনকে নিয়ে একটি ‘লং ড্রাইভ’ গ্রুপ বানান শিবাজী ও তাঁর বন্ধুরা। রবিবার সেই দলেরই ট্যুর ছিল। শিবাজীর এক বন্ধু বলেন, ‘‘প্রতি রবিবার সকালে পরিবারের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেরোই আমরা। শহরের বাইরে কোথাও খেতে যাওয়া হয়। কোনও রবিবার স্ত্রীয়েরা বাদ, শুধুই ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয়।’’ রবিবার সে রকমই একটি দিন ছিল। শুধু সন্তানদের নিয়ে বেরিয়েছিলেন শিবাজীরা। ফেরার পথেই সব শেষ!

স্বামীর মৃতদেহ শববাহী গাড়িতে তোলার মুখে শিবাজীর স্ত্রীর আকুতি, ‘‘গাড়িটা তো আমার পছন্দে কিনেছিলে, কেন আমাকেও তোমার সঙ্গে নিলে না!’’

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক, দীপঙ্কর মজুমদার, ফেসবুক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE