Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আধার-লড়াই জিতলেও জীবনের যুদ্ধে হার

সনৎকুমার মৈত্র। সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত বছর সাতাশের এই তরুণকে নিয়েই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল ২০১৭ সালের নভেম্বরে।

ছেলের ছবি হাতে নূপুরদেবী। নিজস্ব চিত্র

ছেলের ছবি হাতে নূপুরদেবী। নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৯ ০৩:৩৩
Share: Save:

পাঁচিলে ঘেরা বাড়ির বাগান পেরিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেললেন মহিলা। ঘরের পথ দেখানো ছেড়ে বলতে শুরু করলেন, কোথায় বসে খোকা পাখি দেখত, কোথায় খোকার জন্য লিফট বসানোর পরিকল্পনা ছিল, কোথায় খোকার পৈতে হয়েছিল— সেই সব! বাড়ির একটি সিমেন্টের স্ল্যাবের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘হুইলচেয়ারে ওকে নামাতে খুব সমস্যা হত। তাই এটা বানিয়েছিলাম। আর কী হবে!’’ স্ল্যাবের নীচে দুপুর রোদে শুয়ে থাকা একটি কুকুরকে দেখিয়ে এর পরে তিনি বলেন, ‘‘সনৎ তো আর নেই। এই কুকুরটাই শুধু আমাকে ছেড়ে যায়নি!’’

সনৎকুমার মৈত্র। সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত বছর সাতাশের এই তরুণকে নিয়েই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল ২০১৭ সালের নভেম্বরে। হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে সনতের মা নূপুর মৈত্র জানিয়েছিলেন, ছেলেকে নিয়ে দেড় বছর ধরে ঘুরেও আধার কার্ড করাতে পারেননি। কার্ড পেতে কোনও ক্যাম্প-অফিস বাদ রাখেননি। নেতা-মন্ত্রী, পুরসভার দ্বারস্থ হয়েও সুরাহা হয়নি। যেখানেই গিয়েছেন, বলা হয়েছে, ক্যামেরার দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে না পারলে কার্ড হবে না। হাতের আঙুলের ছাপ দিতেও সমস্যা হচ্ছে।

সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্তের এই যন্ত্রণা শুনে হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক জানতে চেয়েছিলেন, আধার কার্ড থাকা কি বাধ্যতামূলক বলেছে কেন্দ্র? তা হলে কার্ড পেতে কাউকে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে হবে কেন! সনতের মতো প্রতিবন্ধীরা কী করবেন, তা জানাতে হবে কেন্দ্রকেই। কোর্টের লড়াই শেষে জয় হয় সনৎদের। আধার কার্ড পান সনৎ। শনিবার নূপুরদেবী বললেন, ‘‘বিচারপতি ওকে বাঁচিয়েছিলেন। কোর্টে জিতলেও জীবনযুদ্ধে আমরা হেরে গিয়েছি। খোকাকে তো বাঁচাতেই পারলাম না। আধার কার্ডটা দিয়ে আর কী হবে!’’ তবে নিজের ছেলের স্মৃতি ধরে রাখতে চান মা। নিজের সঞ্চিত টাকা তিনি দিতে চান সনতের মতো সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ছেলে-মেয়েদের সাহায্যে। ছেলের মৃত্যুর পরে আর অফিস যেতে ভাল লাগে না নূপুরদেবীর। ২০২১ সালে অবসর নেওয়ার কথা তাঁর। কিন্তু তার আগেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। তিনি বলেন, ‘‘সনতের মতো যাঁরা সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত, তাঁদের সাহায্যে সঞ্চিত টাকা দিতে চাই।’’

মহিলা বলে চলেন, জন্ম থেকেই রোগাক্রান্ত তাঁর খোকা তবু এক রকম বাঁচতে শিখে নিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে (জোকা) কর্মরতা নূপুরদেবী প্রথমে সময়মতো অফিসে যেতে পারতেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ছেলের পরিচর্যায় দিন কাটত তাঁর। পরে ২০১৩ সালে সনতের বাবা সমর মৈত্র অবসরগ্রহণ করলে ছেলেকে স্বামীর কাছে রেখে অফিসে কিছুটা নিয়মিত হয়েছিলেন তিনি। এই সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে এক ধরনের জ্যাকেট সর্বক্ষণ পরিয়ে রাখা হত সনৎকে। সনৎ ঘাড় সোজা রাখতে পারতেন না। সোজা হয়ে বসার বা কথা বলারও ক্ষমতা ছিল না তাঁর। বলতে পারতেন স্রেফ একটি করে শব্দ। তার মধ্যেই চেষ্টা চালিয়ে প্রয়োজনের সময়ে ছেলের কাছ থেকে সাড়া আদায় করে নিতেন মা। কান্নায় ভেঙে পড়ে নূপুরদেবী বলেন, ‘‘শেষের দিকে বাথরুমে যেতে হলে বোঝাতে পারত। এক রকম সব ঠিকঠাকই চলছিল। কী যে হল!’’

নূপুরদেবী জানান, গত ১০ মার্চ জ্বর নিয়ে ডায়মন্ড হারবার রোডের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন সনৎ। পাঁচ দিন ওখানেই ছিলেন। রাইলস টিউব দিয়ে খাওয়ানো শুরু হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, আশা বিশেষ নেই। শেষে বমি হতে শুরু করে সনতের। ১৪ মার্চ তাঁকে আইসিইউ-তে স্থানান্তরিত হয়। নূপুরদেবী বলেন, ‘‘১৫ মার্চ সকালেই সব শেষ!’’ কয়েক মিনিট চুপ থেকে তিনি আবার বলেন, ‘‘সনৎ গরম ভাত আর আলুসেদ্ধ ভাল খেত। রাইলস টিউব দেখেই বুঝেছিলাম, সময় শেষ। মৃত্যুর আগে একটু ভাতও খেতে পেল না খোকা! ওঁর মতো ছেলেমেয়েদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে যেতে চাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE