Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
আমার পাড়া

লেক মল মাথা তুলতেই হারিয়ে যাচ্ছে পাড়া

গাড়ি-ঘোড়া-ট্রাম চলা রাজপথের গাঁ ঘেষা গলিটায় সকাল থেকে রাত বাজারের হট্টগোল। সাতসকালে রাস্তা আটকে মুরগি আর দুধের গাড়ির লড়াই, ফুটপাথের সব্জি বাজারে দরকষাকষি, রাধুবাবুর দোকানে চায়ের আড্ডায় তুমুল তর্ক যেন অ্যালার্ম ক্লক।

চৈতী ঘোষাল
লেক মার্কেট শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৫ ০১:০৬
Share: Save:

গাড়ি-ঘোড়া-ট্রাম চলা রাজপথের গাঁ ঘেষা গলিটায় সকাল থেকে রাত বাজারের হট্টগোল। সাতসকালে রাস্তা আটকে মুরগি আর দুধের গাড়ির লড়াই, ফুটপাথের সব্জি বাজারে দরকষাকষি, রাধুবাবুর দোকানে চায়ের আড্ডায় তুমুল তর্ক যেন অ্যালার্ম ক্লক। আর সেখানেই কদমগাছে এক জোড়া দোয়েলের রোজকার আসা-যাওয়া। ধুলো-ধোঁয়া-শব্দের তোয়াক্কা না করেই। সেই আমার পাড়া।

জনক রোড।

দোয়েল দুটোকে দেখি না বহু দিন হল। সাবেক লেক মার্কেট এখন ঝাঁ-চকচকে লেক মল। পুরনো পাড়ার মোড়ক ভেঙে মাথা তুলছে বহুতল। সেকেলে বাড়ি, হিন্দু হোটেল, ভাজাভুজির গন্ধ মাখা গলিতে বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। দোকানপাট বাড়ছে হুড়মুড় করে। ঠিকানা বদলাচ্ছে চেনা মুখগুলো। ছেলেমেয়েরা বড়
হয়ে এ দিক-সে দিক। শুধু শেকড় আঁকড়ে পড়ে কিছু প্রবীণ। এই পাড়াটাই আমার। এখনও। মলের ঝলমলানির মধ্যেই খানকয়েক পুরনো বাড়ি, ঝকঝকে চেহারা পেরিয়ে খানিক ভাঙাচোরা। আধুনিক, তবু সাবেকও বটে।

সালকিয়ার পৈতৃক বাড়ি থেকে লেক গার্ডেন্সে বড় হয়ে ওঠা। হাত বাড়ালেই স্টুডিও, সিনেমাপাড়ার লোকেদের আনাগোনায় জমজমাট সেই চৌহদ্দি ফেলে আসা আমাকে এই পাড়া বরণ করেছিল নতুন বৌ হিসেবে। আমার ছেলেও হল এ বাড়িতেই। দেখতে দেখতে কুড়িটা বছর পার। এতগুলো বছরে কত কী যে বদলে গেল! কিছু ভাল, কিছু মন্দ।

সাবেক বাঙালি পাড়া। মধ্যবিত্তের বসত। মানে, আড্ডা, গান, পুজো এবং খাওয়াদাওয়া। সঙ্গে বাঙালির ভূরিভোজের চেনা ঠিকানা— রাধুবাবুর চায়ের দোকান। সে দোকান আমার বাড়ির ঠিক নীচে। চারটে বাজতে না বাজতেই চিংড়ির চপের ম ম করা গন্ধ, মানে যাকে বলে ‘মরমে পশিল’ অবস্থা। আমাদের ঝুল বারান্দাটায় কোনও আড্ডাতেই বোধহয় সে বাদ পড়েনি। বারান্দা থেকে একটা হাঁক দিলেই হল। চপ-কাটলেট-কবিরাজি পৌঁছে যাবে যথাস্থানে। লেক মলের ঝকঝকে দোকান, ব্র্যান্ডেড মিষ্টির দোকান পেরিয়ে ছোটখাটো মিষ্টির দোকানগুলোই বা কম কীসে! সেগুলোর খাঁটি বাঙালি ছোট্ট জিলিপি ছাড়া রবিবারের সকালটাই তো অসম্পূর্ণ! আর হিন্দু হোটেলগুলো? তাদের পরিপাটি বাঙালি খাবারের সুস্বাদ? লেক মল বা ঝকমকে দোকানগুলোর পাশে তাদের একটু মলিন লাগে বটে। তবে পরিচ্ছন্ন করে রাখলে ওই পুরনো হোটেলগুলোও থাকুক না। ওগুলো তো এ
পাড়ার চরিত্র।

সারা বছর মিলেমিশে থাকে আমার পাড়া। ছড়িয়েছিটিয়ে আড্ডায়, বিপদে-আপদে পাশে থাকা, খেয়াল রাখায়। আগেকার লেক মার্কেটের গলিঘুঁজির বিকিকিনি, ফুটপাথের পসরা থেকে এখনকার বিজনেস সেন্টার হয়ে ওঠা— দোকানপাটের কল্যাণেই পাড়াটা জেগে থাকে অনেক রাত পর্যন্ত। তাই নিরাপত্তার ভারটাও যেন ওঁরাই নিয়ে নেন, খেয়াল রাখেন। কে কী করছে, খবর রাখেন তারও। এ পাড়ার মেয়েরা বরাবরই ফ্যাশনেবল পোশাক পরে। শ্যুটিংয়ের কারণে আমিও তো নানা ধরনের পোশাকে বাড়ি ফিরি। কেউ কোনও দিন একটা মন্তব্যও করেনি। সাবেক হয়েও লিবারাল আমার পাড়া।

পুজোর দিনগুলোয় হুল্লোড়েও এখানে একসঙ্গে মেতে ওঠে সবাই। আগে শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে অঞ্জলি দিতে যাওয়ার মজাটাই ছিল আলাদা। বছর দুয়েক হল উনি আর পেরে ওঠেন না। ওঁর মতো প্যান্ডেলে অনুপস্থিত হয়ে পড়া বয়স্কদের খোঁজও বোধহয় সে ভাবে আর রাখে না এ পাড়ার ছোটরা। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এ পাড়ায় অবশ্য কালীপুজোটাই আসল। ছোট্ট একটা প্রতিমা, প্যান্ডেলের ইনস্টলেশন, তার শিল্পবোধ তাক লাগানোর মতো। আর সেই সঙ্গে ফুটপাথে স্টেজ করে ফাংশন। শাশুড়ি মায়ের কাছে শুনেছি কত নামী শিল্পী গান গেয়ে গিয়েছেন এখানে। রাতভর চলেছে সেই আসর। এখনও হয় ঠিকই, বড় করেই। তবে আজকাল খানিক রাজনীতির রং লেগেছে সেই ফাংশনে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে আগেকার মহা ধুমধামের বাজি উৎসবও। গলির ওপারটায় একটা মেথরপট্টি ছিল। সেখান হুল্লোড় করে ছটপুজো হতো। সেই বস্তিটা উঠে গিয়েছে লেক মল তৈরির সময়েই। ছটপুজো টেরই পাই না আর। আগে সরস্বতী পুজোটাও বড্ড মজার ছিল। আগের রাত পর্যন্ত প্যান্ডেলের বাঁশের কাঠামো বিক্রি হতো আমাদের বাড়ির নীচটায়। সেই হুল্লোড়ে আমাদের ঘুমের দফারফা! তবু সেই হইচইটাই বড্ড মিস করি এখন।

আর লেক মার্কেট! লোকে বলত, এখানে নাকি বাঘের দুধও পাওয়া যায়! দেখিনি কিন্তু, তবে বিশ্বাস করতেও কসুর করিনি! গাজনের সময়ে সং-ও দেখেছি এখানে। সেই লেক মার্কেটই এখন ঝাঁ-চকচকে বহুতল। আসলে চেনা অলিগলির বাজারটা লেক মল হয়ে গিয়েই অনেক কিছু বদলে গেল এ পাড়ায়। ফুটপাথের দোকানগুলোও উঠে গেল। ওরা কিন্তু পাড়ার লোকের রীতিমতো খেয়াল রাখত। কে কোথায় যাচ্ছে, ঠিকমতো বাড়ি ঢুকল কি না, কে রাস্তায় পড়ে গেল— সব। কারও কিছু হলে বাড়িতে খবর দেওয়ার ভারও নিত ওরাই। আমার ছেলে যে দিন প্রথম একলা বড় রাস্তায় পা রাখল, সে খবরও পেয়েছি ফুটপাথের চালওয়ালি মাসির কাছে। ওঁরা উঠে যাওয়ায় খবর দেওয়ার লোক কমে গিয়েছে খানিক।

হ্যাঁ, ভাল হয়েছে অনেক। গলির মধ্যে বিশাল একটা ভ্যাট ছিল। পাড়া, বাজারের যাবতীয় জঞ্জাল জমে উপচে পড়ত। সাফাইকর্মীরা ঠিকমতো না এলে পচে দুর্গন্ধ বেরোত। এখন সেই ভ্যাট রাস্তা থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। বাজারের জঞ্জাল রাখার ব্যবস্থা হয়েছে মলের ভিতরেই। বাড়ি-বাড়ির আবর্জনা আগের মতোই নিয়ে যায় পুরসভার হাতগাড়ি। ফলে গলিটা এখন অনেক পরিচ্ছন্ন। কেউ কেউ অবশ্য এখনও জানলা থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলেন জঞ্জালের প্যাকেট। সে অভ্যাসটা যদি একটু বদলানো যেত!

আর কমেছে জল জমা। আগেকার জনক রোড? বাপরে! একটু বৃষ্টিতেই কোমর জল। গাড়ি ডোবার দশা। স্টুডিওয় যাতায়াত করতে প্রায় সাঁতরাতে হতো। বছর কয়েক হল সেই গলিতেই জলে জমে না বললেই চলে। নিকাশির হাল ফিরেছে। তার কৃতিত্ব কিন্তু পুরসভার প্রাপ্য। আগে পার্কিংয়েরও কোনও বিধিনিষেধ ছিল না এ পাড়ায়। যে যার মতো গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখত। ফলে যখন-তখন একেবারে জটপাকানো অবস্থা হয়ে দাঁড়াত। এখন মল হওয়ার পরে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। ফলে সমস্যাটাও এড়ানো গিয়েছে অনেকখানি। আর পার্কিংয়ে পুলিশি নজরদারিও থাকে। ফলে পাড়ার নিরাপত্তাও বেড়েছে খানিক। তবে সাইকেলে পুলিশি টহল কিন্তু আর চোখে পড়ে না।

আমার পাড়াটা শান্তিপূর্ণ। কোনও দিনই রাজনীতির রং নেই সে ভাবে। সব দল মোটামুটি মিলেমিশে থাকে। এখানকার বিধায়কের উদ্যোগে রাজনৈতিক গোলমাল নেই তেমন। চুরি-চামারি বা অন্য অপরাধও হয় না বললেই চলে।

তবে খারাপও আছে। মল গড়তে গিয়ে ধুলো-ধোঁয়া-দূষণ ঢুকে পড়েছে এ পাড়ার বাতাসে। মলের এসি-টায় কোনও সাইলেন্সার বসানো নেই। আওয়াজে পাড়ার বয়স্কদের বড্ড অসুবিধে হয়। এর পরে মাল্টিপ্লেক্সটা খুলে গেলে হয়তো এ সমস্যা আরও বাড়বে। এ দিকটা কেন যে কর্তৃপক্ষ একটু নজর দিচ্ছেন না! লাগোয়া পরাশর রোডে এখনও বহাল তবিয়তে ফুটপাথ জুড়ে দোকানপাট চলছে। ওদের জন্য রীতিমতো যানজট হয়ে যায় যখন-তখন। শুনেছি, পুলিশকে টাকা দিয়েই ওরা এমন অকুতোভয়। পুরসভার জলের কল থেকেও দেখি দিনরাত জল পড়ে যায়, প্যাচপেচে হয়ে থাকে রাস্তা। জলের অপচয়টা বন্ধ হওয়া দরকার।

যৌথ পরিবারের মতো থাকা সেকেলে পাড়াটা বড্ড হুড়মুড়িয়ে দোকানপাটে ছেয়ে যাচ্ছে। পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল, তাদের আকাশছোঁয়া দাম। পুরনো বাড়ি,
চেনা মুখ বদলে আসছে নতুন নতুন লোক। বাড়ছে অবাঙালি মানুষের সংখ্যা। নতুন মানুষদের তো আর পাড়াটাকে ভালবাসার, সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার টান নেই। তাই চরিত্র বদলাচ্ছে আমার পাড়া। ওঁরাও যদি সাবেক বাসিন্দাদের মতো পাড়াটাকে ভালবাসতে পারতেন! পাড়ার পুরনো গন্ধটাও এখটু টিকিয়ে রাখতে চাইতেন! আর ছোটদের প্রজন্মটা ছড়িয়েছিটিয়ে যাওয়ায়, ব্যস্ততা বাড়ায় বয়স্কদের সঙ্গে তাদের তেমন যোগাযোগ নেই। একলা বুড়োবুড়ি বসে থাকেন বাড়িতে, তাঁদের জোর করে পুজোর প্যান্ডেলে নিয়ে যাওয়ার লোক কই? অথচ ওঁরাই তো পাড়ার শেকড়। ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা দল গড়া যায় না? যারা পাড়ার বয়স্কদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে, পাশে থাকবে? খবরের কাগজে যা সব পড়ি আজকাল!

ভাল-মন্দে তবু এ পাড়াটা এখনও আমার প্রাণ। আর একটা ফ্ল্যাট আছে বটে আমার। তবে বাড়ি? এই জনক রোড।

লেখক বিশিষ্ট অভিনেত্রী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE