Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

শাসকের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে চিড় স্পষ্ট

বড়সড় কোনও ভাঙন এখনও ধরেনি। কিন্তু চি়ড় ধরা পড়ছে শাসক দলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে। কলকাতায় পুরভোটের বিশদ ফল সামনে আসতে শুরু করার পর থেকেই এই নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। এর পরেই বিধানসভার ভোট। তার মধ্যে দ্রুত চি়ড় মেরামত করা দরকার বলে দলের নেতাদের অনেকের অভিমত।

সঞ্জয় সিংহ
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০৪:২২
Share: Save:

বড়সড় কোনও ভাঙন এখনও ধরেনি। কিন্তু চি়ড় ধরা পড়ছে শাসক দলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে। কলকাতায় পুরভোটের বিশদ ফল সামনে আসতে শুরু করার পর থেকেই এই নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। এর পরেই বিধানসভার ভোট। তার মধ্যে দ্রুত চি়ড় মেরামত করা দরকার বলে দলের নেতাদের অনেকের অভিমত।

অতীতে এ রাজ্যে মুসলিমদের সমর্থনের একাংশ বাম, অন্য অংশ কংগ্রেসের দিকেই থাকত। কিন্তু ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোট থেকে সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশই তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। রাজ্যে ২০১১-য় ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইমাম ভাতা দেওয়ার মতো কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে আরও সংখ্যালঘু মন জয়ে সচেষ্ট হন। রমজান-সহ নানা অনুষ্ঠানে তৃণমূল নেত্রীর ‘মুসলিম-প্রীতি’র আধিক্য নিয়ে বিরোধীরা সরবও হয়েছিলেন। কিন্তু সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ‘নিবিড় সম্পর্কে’র ফায়দা গত লোকসভা ভোটেও তুলেছে তৃণমূল। কলকাতার মধ্যে চৌরঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও একই প্রবণতা বজায় ছিল। কিন্তু এক বছর বাদে পুর-নির্বাচনে সেই ভোটব্যাঙ্কে সামান্য হলেও সিঁদ কেটেছে বিরোধীরা।

দলের এক শীর্ষ নেতার আক্ষেপ, ‘‘বড় ধাক্কা এখনও আসেনি ঠিকই। কিন্তু আমাদের মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক যে অটুট নেই, তা বোঝা গিয়েছে ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলমের মতো তৃণমূল প্রার্থী ৯ হাজার ভোটে হেরে যাওয়ায়।’’ এখানে সংখ্যালঘু ভোটের অভিমুখ বামেদের দিকেই। ফরজানার অবশ্য অভিযোগ, তাঁর হারের মূল কারণ দলীয় অন্তর্ঘাত। কিন্তু কেবল ফরজানাই নন, ভোটের ফলে ইঙ্গিত মিলছে, উত্তর থেকে দক্ষিণের সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকায় বিরোধী শিবিরের বেশির ভাগ সংখ্যালঘু প্রার্থীর ভোট বেড়েছে।

উত্তর কলকাতার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের শান্তনু সেন ‘মস্ত জয়’ পেয়েছেন। ১৪ হাজারেরও বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি। কিন্তু সেখানেও কংগ্রেসের মহম্মদ কলিম ৩০০০ ভোট পেয়েছেন। গত পুরভোটে এখানে কংগ্রেস প্রার্থী শ’পাঁচেক ভোট পেয়েছিলেন। গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোট অবশ্য সামান্য বেড়ে ৭০০ হয়েছিল। পাশেই ৬ নম্বর ওয়ার্ডেও দলের মুসলিম প্রার্থীর ভোট আগের তুলনায় বেড়েছে বলে প্রদেশ কংগ্রেস সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান খালেক এবাদুল্লার দাবি। একই ভাবে, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডেও কংগ্রেস প্রার্থীর ভোট বেড়েছে। আর পাশেই ২৯ নম্বরে কংগ্রেসের প্রকাশ উপাধ্যায় এ বারে তো ‘জায়েন্ট কিলার’ আখ্যায় ভূষিত! কারণ, তৃণমূলের ওজনদার প্রার্থী, বিধায়ক পরেশ পালকে তিনি ৮ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়েছেন। এবাদুল্লার দাবি, ‘‘ওই ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৯৯% বাসিন্দাই মুসলিম।’’ এমনকী, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডেও লোকসভার পরে এ বার পুরভোটেও মুসলিম ভোট অনেকটাই শাসকদের দিক থেকে তাঁদের দিকে এসেছে বলে কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি।

মধ্য কলকাতায় কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি ৪৫ নম্বর ওয়ার্ড। এ বারও সেই ঘাঁটি ধরে রেখেছেন কংগ্রেসের সন্তোষ পাঠক। তাঁর দাবি, ‘‘ওয়ার্ডের বাসিন্দা মুসলিমদের বড় অংশ এ বারও আমাকে ভোট দিয়েছেন।’’ এখানে বাসিন্দাদের প্রায় ৩৫% মুসলিম। মুসলিম ভোট যে বিরোধীদের ঝুলিতে অল্প হলেও যেতে শুরু করেছে, তার আরও বড় প্রমাণ ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেসের শগুফ্‌তা পরভিনের জয়। তৃণমূলের শ্বেতা ইন্দোরিয়াকে তিনি প্রায় ২৩০০ ভোটে হারিয়েছেন। সংখ্যালঘুরা তাঁদের দিকে ফিরেছেন বলেই এই জয় তাঁরা পেয়েছেন বলে কংগ্রেস নেতাদের দাবি।

ভোটের সময় কলকাতায় মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা রীতিমতো চষে-ফেলা এবাদুল্লা জানিয়েছেন, গত লোকসভা ভোটের তুলনায় এ বার পুরভোটে কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোট বেড়েছে ৭৬, ৭৮, ১৩৩ থেকে ১৪১ নম্বর ওয়ার্ডে। এর মধ্যে বন্দর এলাকায় ১৪০ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের মেয়র পারিষদ মইনুল হক চৌধুরীকে হারিয়েছেন কংগ্রেসের আবু মহম্মদ তারিক। এবাদুল্লা-সহ কংগ্রেস নেতাদের অনেকেরই ব্যাখ্যা, লোকসভা ভোটের সময়ে মোদী-হওয়ার বিপরীতে এ রাজ্যে মুসলিমদের বড় অংশ তৃণমূলের আশ্রয়ে চলে গিয়েছিল। সেই সময়ে বেহাল কংগ্রেসের উপরে তারা ভরসা করেনি। কিন্তু গত এক বছরে তৃণমূলের ‘কাজে’ তারা বীতশ্রদ্ধ। এখন যে বিরোধী যে এলাকায় শক্তিশালী, সেখানে সেই দলের দিকেই সংখ্যালঘুরা সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে তাঁদের যুক্তি।

প্রায় একই যুক্তি সিপিএম নেতাদেরও। কলকাতার বুথওয়াড়ি বিশ্লেষণ এখনও শেষ হয়নি। তবু প্রাথমিক হিসাব পর্যালোচনা করেই কলকাতা সিপিএমের নেতা অনাদি সাহুর ব্যাখ্যা, ‘‘সামান্য হলেও সংখ্যালঘু ভোটের একাংশ কংগ্রেস এবং আমাদের দিকে ফিরেছে। বিজেপি-র হাওয়া যখন তোলা হয়েছিল, তখন উল্টো দিকে মেরুকরণের ফায়দা নিয়েছিল তৃণমূল। এখন সেই তৃণমূল যে তলায় তলায় বিজেপি-র সঙ্গে সমঝোতা করছে, ধীরে হলেও সংখ্যালঘুরা তা বুঝতে পারছেন।’’

তৃণমূলের নেতা এবং রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং ফিরহাদ (ববি) হাকিম অবশ্য বিরোধীদের দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। সুব্রতবাবুর বক্তব্য, ‘‘লোকসভা বা বিধানসভার ভোটে যে মানসিকতায় মানুষ কোনও দলের প্রার্থীকে ভোট দেয়, পুরভোটে তা হয় না। সেখানে প্রার্থীর ভাবমূর্তিই তারা বিচার করে।’’ ববি সরাসরিই বলছেন, ‘‘মুসলিমেরা তৃণমূলের সঙ্গেই আছেন। পুরভোটে মুসলিমেরা আমাদের প্রতি বিরূপ হলে ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে আমাদের তরুণ প্রার্থী ফৈয়াজ আহমেদ খান ৩০ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতত না। আমাদের দিকে মুসলিমদের সমর্থন অটুট আছে বলেই ৬২ নম্বর ওয়ার্ডে সানা আহমেদ ১৬ হাজারেরও বেশি ভোটে জয়ী হয়েছে।’’ আর ৬৫ নম্বরের ফারজানা বা ১৪০ নম্বরে মইনুলের হারের কারণ ভিন্ন বলে জানিয়েছেন ববি। তাঁর মতে, ‘‘ওঁদের কিছু ভুল তো ছিলই। আর ফরজানা যে ওয়ার্ড থেকে লড়েছেন, সেটা বামেদের দখলেই ছিল। আর মইনুল তো গত বার প্রথমে কংগ্রেসে ছিলেন। পরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে ওখানেও আমাদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরেছে, এমন ভাবার কারণ নেই।’’

তবে ফৈয়াজ বা সানার ‘মস্ত জয়’ দেখিয়ে ববি যে তাঁদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত দেখানোর চেষ্টা করছেন, তা নিয়ে শাসক দলের অন্দরে অনেকেই বিস্মিত! তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, সময় থাকতে সতর্ক না হলে বিধানসভা ভোটে মাসুল গুনতে হতে পারে দলকে। বিশেষত, সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কয়েক বার কয়েক জন ইমাম-সহ কিছু সংখ্যালঘু ব্যক্তিত্ব যে ভাবে মুসলিম উন্নয়নে তৃণমূল সরকারের দাবি নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, তার প্রভাব ধীরে ধীরে পড়তে পারে বলেই তাঁদের আশঙ্কা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE