Advertisement
১৭ মে ২০২৪

বহু মণ্ডপে দেবী আসছেন ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ রূপে

যে পুজোর থিম ‘বাণিজ্যে বসতে বাঙালি’, তাদেরই এ বার বাজেট ছেঁটে ফেলতে হয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ! দু’বছর আগে ‘কহানি’ ছবির দৌলতে দক্ষিণের যে পুজো ঘিরে আগ্রহ ছিল তুঙ্গে, এ বার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে তারা।

দেবাশিস চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:২২
Share: Save:

যে পুজোর থিম ‘বাণিজ্যে বসতে বাঙালি’, তাদেরই এ বার বাজেট ছেঁটে ফেলতে হয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ!

দু’বছর আগে ‘কহানি’ ছবির দৌলতে দক্ষিণের যে পুজো ঘিরে আগ্রহ ছিল তুঙ্গে, এ বার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে তারা।

উল্টোডাঙার যে পুজো বছরের পর বছর ভিড় টেনেছে, স্পনসরের প্রত্যাশায় বসে থেকে থেকে এ বারে তারা বেদম। বাজেট কমছে ৮-৯ লাখ টাকা।

শহরে মাঝারি বাজেটের পুজোগুলোয় (যাদের খরচ ৩০-৩৫ লক্ষের মধ্যে থাকে সাধারণত) এ বছর এমনই ছবি। তা সে প্রত্যন্ত দক্ষিণই হোক, বা উত্তর শহরতলি। পুজোকর্তারা সকলেরই প্রায় এক সুর, টাকার যে স্রোত ছিল বেশ ক’বছর ধরে, তা যেন হঠাৎই শুকিয়ে গিয়েছে। কেন?

সরাসরি জবাব না দিয়ে অনেকেই তুলে ধরছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য। কয়েক দিন আগে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “পয়সায় এ বার অনেকেরই টান আছে। আগে বিভিন্ন চ্যানেল, কাগজ স্পনসর করত। এখন কমে গিয়েছে।” ক্লাবগুলিকে সাহায্য করতে পুরসভা এবং নেতা-মন্ত্রীদের এগিয়ে আসতেও বলেছেন তিনি।

পুজোকর্তাদের অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সারদাও কিন্তু নিজস্ব টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র ছিল। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা একাধিক সর্বজনীনকে অর্থ সাহায্য করত। গত বছর এপ্রিলে সুদীপ্ত সেন বেপাত্তা হওয়ার পরে অনেক পুজোই বুঝে যায়, এই অর্থের দিন ফুরলো।

“কিন্তু গত পুজোতেও এই হাহাকারটা ওঠেনি,” বললেন শিবমন্দির সর্বজনীনের পার্থ ঘোষ। তাঁদের পুজোর বাজেট গত বারেও ছিল ৩২ লক্ষ টাকা। এ বারে সেটাই নেমে এসেছে ২০-তে। পার্থবাবু জানালেন, তাঁদের পুজো সারদার টাকা নেয়নি কখনও। তা হলে এমন হাল হচ্ছে কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, সারদার সঙ্গে বিষফোঁড়ার মতো যোগ হয়েছে রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু শিল্পপরিস্থিতি।

২০০৬ সালে শিবমন্দিরের গোটা পুজোটাই স্পনসর করেছিল ডানলপ। সেই টায়ার প্রস্তুতকারী সংস্থা এখন অন্ধকারে। ছ’বছর বন্ধ থাকার পরে হুগলির সাহাগঞ্জের কারখানা খুলেছে ঠিকই, কিন্তু আশা দেখছেন না কেউই। জেসপ-সহ বহু সংস্থার এক রকম বেহাল। একের পর চটকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পুজোর আগে। নতুন শিল্পেরও দেখা নেই। ফলে কমছে বাণিজ্য। এবং তার ধাক্কায় কমছে বিজ্ঞাপন বা স্পনসরশিপের স্রোত। বালিগঞ্জ কালচারালের অঞ্জন উকিলের কথায়, “এ বার আমরা যা কিছু বড় বিজ্ঞাপন পেয়েছি, প্রায় সবই মুম্বই, দিল্লির সংস্থা থেকে।”

হঠাৎ বাজারে এমন খরা কেন? পুজোকর্তাদের বক্তব্য, এর পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। এক তো শিল্পের হাল এতই খারাপ যে স্পনসরের সংখ্যা কমছে। দ্বিতীয়ত, যারা আছে তারাও চলে যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের পুজোয়। তৃতীয়ত, পুজোয় টাকা দিতে গিয়ে রাজনীতির চক্করে পড়তে হতে পারে বলে কিছু সংস্থা হাতই গুটিয়ে নিয়েছে।

ফলটা হয়েছে মারাত্মক। কালীঘাট অঞ্চলের পুজো ৬৬ পল্লির শুভজিৎ সরকার জানালেন, যে গেট বিক্রি করে এর আগে তাঁরা ৪০ হাজার টাকা পেতেন, তার জন্য এ বারে ২০ হাজারের বেশি এক কানাকড়িও মিলছে না। হোর্ডিংয়ে যেখানে ১০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ থাকত, এ বারে তার জন্য পকেটে আসছে ঠিক অর্ধেক।

উল্টোডাঙার তেলেঙ্গাবাগানেও এক ছবি। সেখানেকার অন্যতম উদ্যোক্তা রানা দাসের কথায়, গেট দেখে কথা পাকা করে গেল এক সংস্থা। চূড়ান্ত দাম জানিয়ে দেওয়ার কথা দু’এক দিনের মধ্যেই। অথচ সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে, তাদের আর কোনও সাড়া-শব্দ নেই।

পরিস্থিতি সঙ্গীন হতেই বাজেটে কাটছাঁট শুরু করেছেন অনেকে। যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বিখ্যাত ছিল বালিগঞ্জ কালচারাল, সেটি তারা পুরো ছেঁটে ফেলছে এ বারে। অন্যরা কেউ নতুন শিল্পী ধরছেন, যাতে সে দিকে খরচ কম হয়। কেউ মণ্ডপ ঘিরে খাবারের স্টল বেচায় জোর দিচ্ছেন।

কিন্তু সকলেই মানছেন, দিন ভাল নয়। রাজ্য যেখানে শিল্পে খরা, সেখানে নতুন বিজ্ঞাপন বা স্পনসর আসবে কী ভাবে! যেটুকুও বা আছে, তারা যাচ্ছে নেতা-মন্ত্রীদের ঘরে। নাম করতে না চেয়ে অনেকেই শুনিয়েছেন এ কথা। বলেছেন, “তাই বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি ডোবার পরও ওঁদের ঘরে অভাব ঢোকেনি। কারণ, আমাদের যাঁরা টাকা দিতেন, তাঁরা এখন ওঁদের ঘাটতি পুষিয়ে দিচ্ছেন। ফাঁক পড়ছি শুধু আমরা।”

কেউ কেউ বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী অবস্থাটা ভালই বুঝতে পারছেন। না হলে সাধে কী পুরসভা আর নেতা-মন্ত্রীদের বলেছেন অভাবী পুজোগুলোকে সাহায্য করতে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE