Advertisement
১১ মে ২০২৪
medical

শয্যা পেতে হাহাকার, ট্রলি আটকেই দীর্ঘ অপেক্ষা রোগীদের

বাসের ধাক্কায় দু’টি পা মারাত্মক জখম হলেও শয্যা পাননি হাওড়ার ঘোড়াবেড়িয়ার বাসিন্দা তপন দলুই।

দখল: এসএসকেএম হাসপাতাল চত্বরে স্ট্রেচারেই শুয়ে রোগী।

দখল: এসএসকেএম হাসপাতাল চত্বরে স্ট্রেচারেই শুয়ে রোগী। নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:২৩
Share: Save:

এসএসকেএমের কার্ডিয়োলজি বিভাগের কাছেই তৈরি হয়েছে নতুন টিকিট কাউন্টার। তার পাশেই গাড়ির ভিড় থেকে মাঝেমধ্যে মাথা তুলছেন দুই ব্যক্তি। সম্প্রতি এমন দৃশ্য দেখে কাছে যেতে দেখা গেল, ট্রলিতে শুয়ে রয়েছেন তাঁরা। এখানে শুয়ে কেন? উত্তর নেই!

প্রশ্নটা আবার করতেই টিকিট কাউন্টারের গা ঘেঁষে থাকা ট্রলির যুবক বললেন, ‘‘এক মাস ধরে তো এখানেই আছি।’’ পাশের জনের দাবি, তিনি দিন কয়েক হল এসেছেন। শয্যা নেই, তাই তাঁর ভাই ট্রলিতেই থাকার ব্যবস্থা করেছেন। ওই ভাবে দু’জনকে ট্রলি আটকে রাখতে দেখে অন্য রোগীর পরিজনদের বক্তব্য, ‘‘মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, হাসপাতালে ট্রলি পাওয়া যাচ্ছে না। রোগীকে ওয়ার্ড থেকে অন্যত্র নিতেও অনেক সময়ে ট্রলি মেলে না। সেখানে ওঁরা কী ভাবে ট্রলি আটকে রয়েছেন? কর্তৃপক্ষের নজর রাখা উচিত।’’

নজরদারিতে যে খামতি রয়েছে, তা বোঝা যায় টিকিট কাউন্টারের গা ঘেঁষে থাকা যুবক আবির আলি শাহের কথাতেই। তাঁর দাবি, কোমরে চোট লেগেছে। তাই বাগনান থেকে দিদি নিয়ে এসেছিলেন এসএসকেএমে দেখাতে। কিন্তু তা নাকি হয়নি! আর তাই কাউন্টারের গ্রিলের জানলায় প্লাস্টিকের ছাউনি টাঙিয়ে, নিজের ব্যাগপত্রও ঝুলিয়ে রেখেছেন তিনি। পাশের জন তারিকুল ইসলামের দাবি, ‘‘ঠিক মতো হাঁটতে পারছি না। আড়াই হাজার টাকা গাড়িভাড়া দিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছি। ডাক্তারবাবুরা কিছু পরীক্ষা করাতে বলেছেন। কত বার আর যাতায়াত করব। এত টাকা নেই।’’

কিছুটা এগিয়ে বহির্বিভাগের নতুন ভবনের সামনে দেখা গেল, ট্রলিতে শুয়ে আরও এক যুবক। পরিজনেরা সামনেই প্লাস্টিক বিছিয়ে বসে রয়েছেন। ঝাড়খণ্ড থেকে আসা ৩৫ বছরের ওই যুবকের নাম নিখিল মণ্ডল। দিনমজুরের কাজ করেন। বললেন, ‘‘আচমকাই পেট ফুলে যেতে শুরু করেছে। কোমর থেকে পায়ের দিক ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে। ঠিক মতো হাঁটতে পারি না। পেটেও ব্যথা হয়। খেলেই বমি পায়। অনেক কষ্ট করে কলকাতায় দেখাতে এসেছি।’’ শয্যা না মেলায় হাসপাতালেই থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তাঁর পরিজনেরা। কাকা সীতারামের কথায়, ‘‘দিনমজুরের কাজ করি। দৈনিক ১৫০-২০০ টাকা মজুরি পাই। ধারদেনা করে ট্রেনে চেপে কলকাতায় নেমে ট্যাক্সি নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। একেবারে চিকিৎসা করিয়ে তবে বাড়ি যাব।’’

বাইরে থেকে খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। আপাতত বাড়ি থেকে আনা শুকনো খাবারই ভরসা। আর তা শেষ হয়ে গেলে সঙ্গে আনা হাঁড়িতে চাল ফুটিয়ে খাওয়া হবে বলেই জানালেন নিখিল। কিন্তু ট্রলিতে কেন আছেন? সীতারাম বললেন, ‘‘ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে ট্রলি এনেছিলাম। ফেরত দিয়ে আসব।’’

বাসের ধাক্কায় দু’টি পা মারাত্মক জখম হলেও শয্যা পাননি হাওড়ার ঘোড়াবেড়িয়ার বাসিন্দা তপন দলুই। দুই পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে দুপুর থেকে অপেক্ষা করে আছেন, কত ক্ষণে গ্রাম থেকে গাড়ি আসবে। তাঁর ভাইপো সীমান্ত বললেন, ‘‘কাকার দুর্ঘটনা ঘটেছে শুনে দু’হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে এসেছি। ফিরতে আবার দু’হাজার লাগবে। বার বার এত টাকা দিয়ে যাতায়াতের ক্ষমতা নেই। কপালে যা আছে, তা-ই হবে।’’

শহরে মোটবাহকের কাজ করেন তপন। সম্প্রতি এক রাতে বাসের ধাক্কায় দু’টি পা জখম হওয়ার পরেই তাঁকে এসএসকেএমে আনা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে জানানো হয়, ট্রমা কেয়ারে শয্যা নেই। অগত্যা সারা রাত হাসপাতালেই কাটিয়েছেন তপন। তিনি জানালেন, পরদিন সকালে অস্থি রোগ বিভাগে গেলে সেখানে দেখার পরে কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে বলা হয়, পরে প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে দেখা করতে। তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। তপনের আক্ষেপ, ‘‘তত দিনে পা দুটো ঠিক থাকবে তো!’’

শয্যা না পেয়ে রোগীদের ট্রলি আটকে অপেক্ষার কথা মেনে নিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। এক কর্তার কথায়, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সকালে এসে কেউ ট্রলি নিয়ে আউটডোরে যাচ্ছেন। তার পরে হয়তো শয্যার জন্য দিনভর রোগীকে ট্রলিতে রেখেই অপেক্ষা করছেন। রাতে বাসস্ট্যান্ড বা হাসপাতালের এ দিক-ও দিক থেকেও ট্রলি উদ্ধার করতে হয়। অনেক রোগী সকালে আউটডোরে দেখাবেন বলে আগের দিন সন্ধ্যায় এসে ট্রলিতে রোগীকে রেখে দেন। ট্রলির সংখ্যা বাড়লেও সমস্যা রয়ে গিয়েছে।’’ (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

medical SSKM Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE