Advertisement
E-Paper

দু’চোখ ভরে দেখলাম জীবনের বয়ে চলা

এমন একটা সময় ছিল যখন আমি ঠাকুর দেখতে চেয়েও দেখতে পারিনি। আবার কখনও ঠাকুর দেখায় অবিশ্বাসী হয়েছি, মনে হয়েছে এত টাকা খরচ করে এত আড়ম্বরের কী আছে? তার পর আবার একটা সময় পুজোর হৈ-চৈ-আনন্দ মিস করেছি।

দেবশঙ্কর হালদার

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০১:১৭

এমন একটা সময় ছিল যখন আমি ঠাকুর দেখতে চেয়েও দেখতে পারিনি। আবার কখনও ঠাকুর দেখায় অবিশ্বাসী হয়েছি, মনে হয়েছে এত টাকা খরচ করে এত আড়ম্বরের কী আছে? তার পর আবার একটা সময় পুজোর হৈ-চৈ-আনন্দ মিস করেছি। যখন পুজোর সময় একটার পর একটা নাটকের শো করেছি তখন লোকে নতুন জামা পরে সেজেগুজে আমাকে, আমার অভিনয়কে দেখতে এসেছে। আমার তখন অনেকসময় নিজেকে ঠাকুর-ঠাকুর মনে হয়েছে।

এখন আবার একটু নাম-টাম হয়েছে বলে লোকে আয়োজন করে আমাকে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যায়। কেমন একটা রোমাঞ্চ হয়! এত আদরযত্ন করছে, পুজোর বিচার করতে বলছে। ভিতর থেকে মনে হচ্ছে, যিনি সকলের বিচার করেন তাঁর বিচার আমি কী করব! এটা তো সেই ছোটবেলার দশার মতো হল, এই ঠাকুরটা ভাল, ওই ঠাকুরটা নয়, এই অসুরটা ভাল, ওই সিংহটা নয়। এটা হলে মনে হবে, ছোটবেলার অবস্থা আর ঘুচলো না। এখন আমি যেটা করতে পারি সেটা হল, সামগ্রিক অনুভূতির নিরিখে একটা মাত্রা নির্ধারণ করা।

আসলে প্রিয়জনের সঙ্গে মনের ভাব বিনিময় করা, অন্যের কথা শোনা, নিজের কথা জানানো, ভাল থাকাটা ভাগ করে নিতে পারলেই মনে হয় উৎসবটা সত্যি শুরু হয়ে গেল। আনন্দে আছি বুঝতে গেলে পাশে কিছু মানুষ লাগে। আনন্দ উপভোগ করতে গেলে মানুষ লাগে। এই আনন্দই বয়ে নিয়ে আসে শারদীয়া। এই যেমন যাঁদের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি তাঁদের সঙ্গে দেখা হল, তাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে কিছুটা সময় কাটল। ঢাকের ছন্দটা শরীরের ভিতরে ঢুকে গেল। সেই ছন্দে একটু দুলুনি হল।

শুক্রবার প্রথম যে পুজোতে গেলাম তা ছিল বেহালায়। রাস্তার উপর যেখানে মেট্রোর কাজ হচ্ছে তার পাশেই মণ্ডপ। মূল থিম ‘বাঁক।’ বাঁক জীবনের হয়, রাস্তার হয়, আবার বাঁক নিয়ে পুণ্যার্থীরা হাঁটেন। সেটা তখন পুণ্য আর শক্তির প্রতীক। আমাদের মেরুদণ্ডেরও বাঁক রয়েছে। ওটা নমনীয়। কখনও এ দিক, কখনও এ দিক বাঁকে। তা না হলে আমরা এগোতে পারব না। আসলে জীবনটাকেও তো মানুষ এইরকম দু’কাঁধে বয়ে নিয়ে চলছে। বহন করছে জীবন ও সভ্যতাকে। বেহালার এই পুজোতেও প্রতিমা ধারণ করে রয়েছে ধরিত্রীকে।

সেখান থেকে গেলাম বেহালারই আরেকটি পুজোয়। সেখানে ফেলে দেওয়া পুরনো কাপড় দিয়ে অ্যাপ্লিক আর কাঁথা র কাজে সেজেছে মণ্ডপ। ঠিক এইরকমই কাজ আগেকার দিনে বাড়ির মেয়েরা সূঁচের যাদুতে তৈরি করে ফ্রেমে ভরে দেওয়ালে সাজিয়ে রাখতেন। কোথাও আবার কাপড়ে বিনুনি তৈরি করে সাজানো হয়েছে নিপুণভাবে। মনে হচ্ছিল, ঠিক আগের মণ্ডপে শরীরের যে কাঠামোয় ভার বহন করে একেবেঁকে চলার কথা দেখে এসেছি সেই শরীরটাকেই যেন এই মণ্ডপের কাপড়ে ঢেকে নিয়ে চলা গেল। যেন একটি পুজো মিশে গেল অন্য পুজোতে।

তৃতীয় গন্তব্য নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘ, যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভূটানের যাবতীয় রঙ, সংস্কৃতি, ধর্মাচরণ, পুজোর উপাচার নিখুঁত ভাবে বোনা হয়েছে। কোনও ফাঁক থাকেনি। মানুষ যেন তাঁর শরীরের কাঠামোয় কাপড় জড়িয়ে এ বার দেবতার স্থানে এসেছে। এখানেও আগের দু’টি পুজোর সঙ্গে এই পুজোর যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। চতুর্থ পুজো শিবমন্দির। সেখানে সবকিছু কাঠের। কাঠের কাজের মণ্ডপ, নিমকাঠের দেবী, কাঠের বারকোশ, কাঠের চামচ, এমনকী কাঠের ক্যারাম বোর্ড। মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলার ঘরের কোণ। যেখানে রাখা থাকত সেই সময়ের আমার একমাত্র খেলার সরঞ্জাম কাঠের ক্যারামবোর্ডখানা। নিমেষে মনে হল, যে মানুষটি এতক্ষণ মণ্ডপে-মণ্ডপে ঘুরল সে এখন ক্রমশ ঘরের দিকে ফিরছে।

ফেরার পথের শেষ পুজোয় সবকিছু দুধ সাদা। যেমন বাড়িতে ফিরে মানুষটি ডুবে গিয়েছে ঘুমে। আর পৌঁছে গিয়েছে সফেদ স্বপ্নের জগতে। এখানেই মিলে গেল পাঁচটি পুজো। এরা একে অন্যের পরিপূরক। উৎসবের তৃষ্ণা মেটাতে আঁজলা ভরে এদের সকলকেই দরকার। সেই আঁজলা ওঠানের সময় আঙুলের ফাঁক গলে কোনওটি হাতের মুঠোয় বেশি থাকতে পারে, কোনওটি কম। কিন্তু তাতে কারও গুরুত্ব খাটো হয় না। আর তাতেই সার্থক হয় উৎসব।

debsankar halder Durga puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy