Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বছর শেষের উৎসব আর টানে না বাপি সেনের পরিবারকে

২০০২ সালে কয়েক জন পুলিশকর্মীরই মারে নিহত সার্জেন্ট বাপি সেনের নাম ১৭ বছর পরেও এলাকায় টাটকা।

স্মৃতি: বাপি সেনের ছবি নিয়ে দুই ছেলে সোমশুভ্র (বাঁ দিকে) এবং শঙ্খশুভ্র। পর্ণশ্রীর বাড়িতে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

স্মৃতি: বাপি সেনের ছবি নিয়ে দুই ছেলে সোমশুভ্র (বাঁ দিকে) এবং শঙ্খশুভ্র। পর্ণশ্রীর বাড়িতে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২০ ০২:১৫
Share: Save:

সারা বছর এক দিকে। আর ৩১ ডিসেম্বর তারিখটি তাঁর কাছে আর এক দিকে।

বছরের শেষ দিনে যখন গোটা শহর মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে, তখন ২৪ বছরের ডোডো নিজেকে ব্যস্ত রাখেন অন্য কিছুর মধ্যে। পড়ার চাপ না থাকলে বিশেষত এই দিনে মা-ভাইয়ের সঙ্গেই সময় কাটান। কথাবার্তা, আচার-আচরণে আধুনিকমনস্ক হলেও এডিটিং নিয়ে পড়াশোনা করা সোমশুভ্র সেনের আর ইচ্ছে হয় না বর্ষবরণের রাতে পার্ক স্ট্রিট যাওয়ার। ১৭ বছর আগের মর্মান্তিক স্মৃতি যেন আজও শিকলের মতো তাঁর দু’পা টেনে ধরে বলতে চায়, ‘‘এমন রাতে পার্ক স্ট্রিটে নয়।’’

বেহালা পর্ণশ্রীর একটি চায়ের দোকানে খোঁজ করতেই দোকানি এক বারে দেখিয়ে দিলেন কলকাতা পুলিশের প্রয়াত ট্র্যাফিক সার্জেন্টের বাড়ির রাস্তা। ২০০২ সালে কয়েক জন পুলিশকর্মীরই মারে নিহত সার্জেন্ট বাপি সেনের নাম ১৭ বছর পরেও এলাকায় টাটকা। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাতে হিন্দ সিনেমার সামনে কলকাতা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সের কয়েক জন কর্মীর হাতে বেধড়ক মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন বাপি। পরিবার জানাচ্ছে, শরীরের বাঁ দিকে ৩৮টি জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল তাঁর। ২০০৩-র ৬ জানুয়ারি মৃত্যু হয় ওই সার্জেন্টের। সেই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল পার্ক স্ট্রিটেই।

কলকাতা পুলিশের নথি বলছে, পার্ক স্ট্রিটে এক তরুণীকে জোর করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছিলেন ওই পুলিশকর্মীরা। বাপি তাঁদের বাধা দেন। তরুণীটি তাঁর বন্ধুর বাইকে চেপে কোনও ভাবে পৌঁছন হিন্দ সিনেমা পর্যন্ত। কিন্তু, মত্ত অবস্থায় থাকা ওই পুলিশকর্মীরা সেখানেও তাঁদের পিছু নেন। বাপি ওই তরুণীকে উদ্ধার করেন। তরুণী চলে যেতেই প্রকাশ্যে বাপিকে বেধড়ক পেটান রিজার্ভ ফোর্সের ওই কর্মীরা।

বাপির বড় ছেলে সোমশুভ্রর কানে আজও বাজে বাবার শেষ কথাগুলো, ‘‘পড়া করে রেখো। এসে পড়া ধরব।’’— সোমবার দুপুরে সরকারি আবাসনের চিলতে ড্রয়িংরুমে বসে বলছিলেন বছর চব্বিশের যুবক।

৩১ ডিসেম্বর দিনটা কী ভাবে দেখেন? সোমশুভ্রর কথায়, ‘‘সারা বছর এক দিকে। এই দিনটা সম্পূর্ণ অন্য দিকে। তখন অনেক ছোট। বাবা বলেছিলেন, ফিরে এসে পড়া ধরবেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘটনার কথা শুনি। বন্ধুরা ডাকলেও এই দিনে আমি কোথাও যাই না।’’ ভাই শঙ্খশুভ্র একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তার কথায়, ‘‘আমার তো তখন মাত্র ক’মাস বয়স।’’

৬ জানুয়ারি বাপির মৃত্যুদিন। ভিতরে শোওয়ার ঘরে সার্জেন্টের পোশাক পরিহিত ভাইয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে দাদা অনুপ সেন বললেন, ‘‘ভাইয়ের মৃত্যুর পরে কেউ আমাদের সামনে রেখে ছবি তৈরি করে ফায়দা তুলেছে। দু’-এক জন ছাড়া সাহায্য করতে তেমন কেউই এগিয়ে আসেননি। আমরা কৃতজ্ঞ ওই ঘটনার তদন্তকারী অফিসার অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁর জন্যই অপরাধীরা সাজা পেয়েছে।’’

বাপির মৃত্যুর পরে কলকাতা পুলিশের অস্ত্র আইন বিভাগে চাকরি পান স্ত্রী সোমা। সোমবার দুপুরে অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে অতীতে ফিরে গেলেন তিনি। ঘটনার কথা মনে করে গলার স্বর বুজে আসে তাঁর। কিছুটা সামলে সোমা বললেন, ‘‘ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরে সে দিন বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছিল। ওকে জোর করে বাড়িতে আটকে রাখলেই মনে হয় ভাল হত। রাত ১২টায় আমায় ফোনে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানায়। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শেষ রাতে ফোনেই দুঃসংবাদটা পাই। ছেলেদের বলেছি, আনন্দ তো সারা বছরই আছে। এই দিনটা বাড়িতে থাক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

New Year Celebration Death Kolkata Traffic Surgent
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE