Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মার্চে শুনলেন মেয়ে মৃত, তবু জুনে উইল কেন

একই বাড়ির মধ্যে থাকেন সকলে। তবু মেয়ে মারা যাওয়ার খবর পাননি বাবা। পাভলভ হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে পার্থ দে সোমবার দাবি করেছেন, তাঁর দিদি ডিসেম্বরের শেষে মারা গেলেও সে খবর বাবাকে তিনি জানিয়েছিলেন মার্চ মাসে।

রবিনসন স্ট্রিটের সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ  দেবাশিস সাহা। — নিজস্ব চিত্র।

রবিনসন স্ট্রিটের সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ দেবাশিস সাহা। — নিজস্ব চিত্র।

শিবাজী দে সরকার ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

একই বাড়ির মধ্যে থাকেন সকলে। তবু মেয়ে মারা যাওয়ার খবর পাননি বাবা। পাভলভ হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে পার্থ দে সোমবার দাবি করেছেন, তাঁর দিদি ডিসেম্বরের শেষে মারা গেলেও সে খবর বাবাকে তিনি জানিয়েছিলেন মার্চ মাসে। কিন্তু তা হলে ৮ জুন সলিসিটরের সঙ্গে দেখা করে অরবিন্দ দে ছেলে এবং মেয়ের নামে উইল করতে চাইলেন কেন? এই রহস্যের উত্তর এখনও পায়নি পুলিশ।

এমনিতে অরবিন্দবাবু বা দেবযানীর মৃত্যুর পিছনে কোনও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের প্রমাণ এখনও মেলেনি। দেবযানী উপোস করে এবং অরবিন্দবাবু গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বলেই পুলিশের ধারণা। কিন্তু তাতেও কঙ্কাল রহস্যের অনেক প্রশ্নের উত্তরই অধরা থেকে যাচ্ছে। তার মধ্যে প্রথম প্রশ্নটিই অরবিন্দবাবুর আচরণকে ঘিরে। এ দিনই পার্থ পাভলভ মানসিক হাসপাতালে মনোবিদদের জানিয়েছেন, দিদির মারা যাওয়ার কথা ১৩ মার্চ বাবাকে জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরেও অরবিন্দবাবু মেয়ের মৃত্যুর খবর চেপে গেলেন কেন, তার সদুত্তর পাচ্ছে না পুলিশ। অরবিন্দবাবুর ভাই অরুণবাবু আগেই দাবি করেছিলেন, ১১ মে তাঁরা যখন অরবিন্দবাবুর ফ্ল্যাটে যান, সেখানে দেবযানীকে তাঁরা দেখেননি। অরবিন্দবাবুকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, দেবযানী একটি হোমে আছেন। ভাল আছেন।

কেন এ কথা বলেছিলেন অরবিন্দ? দু’মাস ধরে মেয়ের মৃত্যু তিনি টের পেলেন না কেন? দেবযানীর মৃত্যুর কথা জানার পরেও তার সৎকার করাননি কেন? মৃত মেয়ের নামে সম্পত্তিই বা লিখতে চাইলেন কেন?

ধোঁয়াশা কাটেনি। এ দিন রবিনসন স্ট্রিটে পার্থদের ফ্ল্যাটে ফের তল্লাশি চালাতে যান ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা এবং শেক্সপিয়র সরণি থানার ওসি অরুণ দে। দেবযানীর ঘরে তল্লাশি চালানোর সময় একটি ডায়েরি এবং বেশ কিছু চিরকুট উদ্ধার করেন তাঁরা। সেগুলো পড়ার পর পুলিশের ব্যাখ্যা, বছর খানেক বা তারও বেশি সময় ধরে বাবার সঙ্গে ছেলে-মেয়ের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। দেবযানী তাঁর লেখায় বাবার উপরে কিছু ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কী কারণে সেই ক্ষোভ, তা পুলিশ স্পষ্ট করে বলেনি।

এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, ‘‘এমন কিছু ঘটেছিল যার ফলে ভাই-দিদি দু’জনেই বাবার থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।’’ এই দূরত্বের ফলে বেশির ভাগ সময় অরবিন্দবাবু নিজের ঘরের ভিতরেই থাকতেন। অরবিন্দবাবুর একটি লেখা উদ্ধৃত করে এক পুলিশকর্তার দাবি, ‘‘উনি নিজেও টানা তিন দিন ধ্যান করেছেন বলে লিখেছেন।’’

এই ভাবে আলাদা থাকার কারণেই কি মেয়ের মৃত্যু তাঁর অজানা থেকে গিয়েছিল? সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। কোনও গন্ধ পেলেন না কেন? তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, কঙ্কালের ঘর কার্যত ‘এয়ার টাইট’ ছিল। অরবিন্দবাবু প্রচুর মদ্যপানও করতেন। পুলিশ সূত্রের খবর, মার্চ মাসে একটি নতুন টিভি কিনেছিলেন পার্থ। একটি বৈদ্যুতিন শো-রুমের কর্মচারী টিভি বসাতে তাঁদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে তদন্তকারীরা জেনেছেন, ওই কর্মচারীও কোনও গন্ধ পাননি।

এ দিন রবিনসন স্ট্রিটের বাড়িতে পুলিশ-ফরেন্সিক-দমকলের একটি যৌথ দল কী ভাবে অরবিন্দবাবুকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল, তার পুনর্নির্মাণ করে। পরে পুলিশ জানায়, অরবিন্দবাবু যে আত্মহত্যাই করেছেন, সেই সম্ভাবনাই আরও জোরালো হচ্ছে। ফরেন্সিক দফতরের কর্তা দেবাশিস সাহা বলেন, ‘‘শৌচাগারের দেওয়ালে একটি দাগও মিলেছিল। কিন্তু সেটি রক্তের দাগ নয়।’’

দেবযানীর মৃত্যু কী ভাবে হল?

পার্থ যা দাবি করেছিলেন, পুলিশি তদন্তেও তারই সমর্থন মিলছে। দেবযানীর লেখা চিরকুট পড়েই পুলিশকর্তারা দাবি করেছেন, গুরুর নির্দেশে ‘ক্রিয়াযোগ’ নামে বিশেষ ধরনের সাধনার জন্য দীর্ঘদিন উপোস করছিলেন তিনি। তার ফলেই সম্ভবত দেবযানীর মৃত্যু হয়। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার জন্য তদন্ত চালিয়ে যাওয়া হবে। দেবযানীর লেখা চিরকুটে প্রতি পাতায় তারিখ-সহ লেখা রয়েছে। তাতে গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেখা চিরকুট মিলেছে। সেখানেও এই যোগ সাধনার কথা বলা হয়েছে। ওই ঘর থেকে ‘অস্টারিটি অ্যান্ড উইমেন’ নামে একটি বইও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সেখানেও এ ধরনের সাধনার কথা লেখা রয়েছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। চিরকুটের তারিখ ও লেখা থেকে মনে করা হচ্ছে, সম্ভবত ডিসেম্বরের শেষেই মৃত্যু হয়েছিল দেবযানীর। পার্থও জানিয়েছিলেন, গত ২৯ ডিসেম্বর তাঁর দিদি মারা গিয়েছিলেন। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ওই দেহটি ঘরের মধ্যেই পচেছিল। ঘরের মধ্যে ম্যাগট বা কৃমিকীটের হদিস পেয়েছেন তাঁরা। তবে কঙ্কালটি দেবযানীরই কি না, সেটা ডিএনএ পরীক্ষার পরেই নিশ্চিত করে বলা যাবে। কুকুর দু’টির মৃত্যু কবে এবং কী ভাবে হয়েছিল সে ব্যাপারে অবশ্য কিছু জানতে পারেননি তদন্তকারীরা। কুকুর দু’টির ময়নাতদন্তের রিপোর্টও এখনও হাতে পায়নি পুলিশ।

পুলিশ এখন অনেকটাই ভরসা করছে পার্থর জবানবন্দির উপরে। পাভলভ মানসিক হাসপাতালে থাকার ফলে পার্থর সঙ্গে ঠিক মতো কথা বলতে পারেননি তদন্তকারীরা। তাই এ দিন পার্থকে ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি-তে সরানোর জন্য ব্যাঙ্কশাল আদালতে আর্জি জানিয়েছিল পুলিশ। তা মঞ্জুর করেছে আদালত। পার্থকে স্থানান্তরিত করার পরে ফের তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন তদন্তকারীরা। প্রয়োজনে মাদার হাউসের সন্ন্যাসিনীদেরও সাহায্য নেওয়া হতে পারে। কারণ, বৃহস্পতিবার মাদার হাউসে গিয়েই প্রথম কঙ্কালের কথা জানান পার্থ। পাভলভে থাকার সময়ও বারবার মাদার হাউসে যেতে চেয়েছেন।

৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের সম্পত্তি এবং পার্থ-দেবযানী-অরবিন্দবাবুর আয়ের উৎস সম্পর্কেও পুলিশের এখনও কিছু তথ্য পাওয়া বাকি। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, ২০১৪ সালে মা মারা যাওয়ার পর থেকে সলিসিটরের মাধ্যমে বারবার ওই সম্পত্তি বিক্রি করার চেষ্টা করেছিলেন অরবিন্দবাবু ও তাঁর ভাই অরুণবাবু। একাধিক বার প্রোমোটারের লোকজন এসে জমি মেপেও ছিল। কিন্তু পরে অরুণবাবু আপত্তি তোলেন। এ নিয়ে পরিবারের অন্দরে গোলমাল বেধেছিল।

যদিও পুলিশের একাংশের দাবি, প্রোমোটার ও সলিসিটরের সঙ্গে পার্থই ঝামেলা করেছিলেন। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে ওই সলিসিটর ও অরুণবাবুকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন তদন্তকারীরা। পুলিশ জানিয়েছে, পার্থ-দেবযানী-অরবিন্দবাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০ লক্ষের কিছু বেশি টাকা রয়েছে। কিন্তু পার্থদের যে ধরনের জীবনযাত্রার সন্ধান পুলিশ পেয়েছে, তা এতে কী ভাবে চলত, তা নিয়েও ধন্দে তদন্তকারীরা। এ দিন লালবাজারের এক কর্তা জানান, পার্থদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য (স্টেটমেন্ট) হাতে আসেনি। সেটা পেলে বোঝা যাবে ওই পরিবারের আরও কোনও সম্পত্তি ছিল কি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE