পুরনো নোটেই বিকিকিনি রবিবারেও। মানিকতলা বাজারে ছবিটি তুলেছেন সুদীপ্ত ভৌমিক।
পাকা পোনাও যে মহার্ঘ্য হবে, কে-ই বা জানত!
মামুলি বলে গণ্য হয়ে ভোজবাড়ির মেনু থেকে কিছুটা যেন ব্রাত্যই হয়েছিল এই মাছ। কিন্তু নোট বাতিলের বাজারে ভেটকি-সহ অন্য সব বাহারি মাছের যখন আকাশ ছোঁয়া দাম, তখন অনুষ্ঠানবাড়ির ভোজে নতুন করে ফিরে আসছে সেই পাকা পোনা। তবে ‘দর’ বাড়িয়ে!
চার দিন আগেও মৎস্য ব্যবসায়ী ও কেটারারদের অধিকাংশের ধারণা ছিল, নোট বদলের ধাক্কায় ভেটকি, বম্বে ভেটকি, ভোলা ভেটকির দাম বাড়বে। কিন্তু পোনা মাছ দিয়ে কোনওমতে সামলে দেওয়া যাবে পরিস্থিতি। কিন্তু আড়তদার, পাইকার, খুচরো বিক্রেতা থেকে কেটারার— সক্কলকে বিস্মিত করে রবিবার, মরসুমের বিয়ের প্রথম তারিখের আগের দিন, পোনা মাছের দামও চড়ে গিয়েছে অনেকটা। এক লাফে কেজি প্রতি ৮০-৯০ টাকা!
অনুষ্ঠানবাড়িতে সাধারণত সাড়ে তিন কেজি থেকে পাঁচ কেজি ওজনের কাতলা ব্যবহার করেন নামী কেটারারেরা। তাঁরা পাইকারদের কাছ থেকে ল্যাজা-মুড়ো, তেল-পটকা, ঘাড় বা কণ্ঠার কাঁটা ছাড়া কেনেন। এই বছর এর আগে অগস্টে ছিল বিয়ের শেষ তারিখ। তখন কেজি প্রতি ওই ভাবে তাঁরা পোনা মাছ কিনেছিলেন ৩৪০-৩৫০ টাকা দরে। রবিবার তার দামই ৪২০-৪৩০ টাকায় দাঁড়িয়েছে বলে জানালেন চক্রবেড়িয়ার একটি কেটারিং সংস্থার ম্যানেজার রানা চট্টোপাধ্যায়। হাওড়ার পাইকারি মাছ বাজারের আড়তদার বিনোদ জায়সবাল জানান, পাকা পোনা মাছ তাঁরা যেখানে গোটা মাছ ১৬০-১৭০ টাকা কেজি দরে কিনতেন, এখন তা কিনতে হচ্ছে ২২০-২৩০ টাকায়।
বড় রুই-কাতলার সবচেয়ে বেশি জোগান আসে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। কলকাতা ও আশপাশের এই পাঁচটি পাইকারি মাছ বাজারে সাধারণত অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে রোজ ৪০-৫০টি মাছ ভর্তি ট্রাক ঢোকে। এক-একটিতে মাছ থাকে সাড়ে দশ থেকে এগারো টন। আড়তদারেরা জানাচ্ছেন, এখন বড়জোর আট-ন’টি ট্রাক ঢুকছে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। ভিন্ রাজ্য থেকে ট্রেনে করে মাছ আসাও প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গিয়েছে।
ভবানীপুরের এক কেটারিং সংস্থার কর্ণধার তপন বারিক ক’দিন আগেই এক বরকর্তাকে বোঝাচ্ছিলেন, বাজেট কমাতে চাইলে ভেটকির বদলে পোনা মাছ করলেও হয়। দু’দিনের মধ্যে সেই পোনার যে এমন দর বাড়বে, কে-ই বা জানত! বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের একটি কেটারিং সংস্থার কর্ণধার প্রবীরকুমার পাল আবার বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম রুই-কাতলা পেতে অন্তত সমস্যা হবে না। অবস্থাটা বুঝতেই পারিনি। জানি না, কী করব!’’
বাগুইআটির একটি কেটারিং সংস্থার কর্ণধার সোমা ঘোষের ব্যাখ্যা, এক দিকে ভেটকি মাছের জোগান কম হচ্ছে বলে বহু পরিবার পোনা মাছের পদে ঝুঁকেছেন, ফলে পাকা রুই-কাতলার চাহিদা এক লাফে বেড়েছে। অন্য দিকে, ভিন্ রাজ্য থেকে মাছ আসার পরিমাণ কার্যত তলানিতে ঠেকেছে। সোমাদেবীর কথায়, ‘‘কলকাতার আশপাশে যে রুই-কাতলার চাষ হয়, তা বিয়ের মরসুমে চাহিদা মেটাতে পারবে না।’’
আড়তদার বিনোদের বক্তব্য, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মালঞ্চ বা উত্তর ২৪ পরগনার খড়িবাড়িতে যে রুই-কাতলা মাছের চাষ হয়, তার ওজন খুব বেশি নয়, দু’-আড়াই কেজির মধ্যে। ভোজবাড়িতে আবার ওই মাছ চলে না। অনুষ্ঠান বাড়ির পোনা মাছের চাহিদার প্রায় পুরোটাই ভিন্ রাজ্যের জোগান দিয়ে মেটানো হয়।
তবে রাজস্থানের কোটায় চম্বল নদীর ড্যামে চাষ হওয়া ৬ থেকে ১২ কেজি ওজনের কাতলা ভর্তি দু’টি ট্রাক কলকাতা ও আশপাশের কয়েক জন পাইকার বিয়েবাড়ির কথা ভেবে আনানোর ব্যবস্থা করেছেন। সেই জন্য তাঁদের ডিমান্ড ড্রাফ্টও পাঠাতে হয়েছে। রবিবার রাতে দু’টি ট্রাক ডানকুনিতে পৌঁছেছে। আজ, সোমবার সকালে হাওড়া পাইকারি বাজারে ২০ টন মাছ নিয়ে ওই দু’টি ট্রাক পৌঁছনোর কথা। আর কেটারারেরা যে ভাবে কেনেন, তাতে ওই মাছের দাম কেজি প্রতি অন্তত ৫০০ টাকা দাঁড়াবে বলে আড়তদারেরা জানাচ্ছেন। তা-ও এই অবস্থা সাময়িক। যা দিয়ে আজকের বিয়েবাড়ি ও পরশুর বৌভাত সামলে দেওয়া যেতে পারে। তার পর?
এমনিতেই ফিশ ফ্রাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় খাঁটি ভেটকির ফিলের দাম কেজি প্রতি হাজার টাকা ছুঁয়েছে। সোমাদেবী বলেন, ‘‘বাজার খুব চড়া, এমন অবস্থাতেও আমরা ফিলে কিনেছি ৮০০ টাকায়। তবে হাজার টাকা! ভাবা যাচ্ছে না।’’ মাছের পাইকার বিনোদের কথায়, ‘‘৮-১০ কেজি ওজনের খাঁটি ভেটকি গোটা আমরা কিনতাম ৪৫০ টাকা কেজি দরে। শনিবারও কিনেছি ৬০০ টাকায়। এমন চললে ফিলের দাম ১২০০ টাকায় পৌঁছবে।’’ এ সব ভেবেই পাকা পোনার কদর বেড়েছিল নোটের আকালের এই বাজারে। সুযোগ বুঝে সে-ও এখন রোয়াব দেখাচ্ছে, বলছেন কেটারারেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy