এ ভাবে প্রকাশ্যেই বিকোচ্ছে তামাকজাত দ্রব্য। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
বাস থেকে নেমে এগিয়ে যাচ্ছেন শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনের দিকে। বিধান সরণির মুখেই থমকে গেল দ্রুত এগিয়ে যাওয়া পা দুটো। পকেটে হাত দিয়ে দশ টাকার দুটো নোট বের করে মধ্যবয়সি এক ভদ্রলোক এগিয়ে দিলেন দোকানিকে। কিছু বলার আগেই দোকানি তাঁর হাতে এগিয়ে দিলেন একটি সোনালি রঙের প্যাকেট। না বলতেই সব বুঝে গেলেন? হেসে দোকানি বললেন, ‘‘ফি-দিনের খদ্দেরকে আবার আলাদা করে বলতে হয় না কি!’’
শহরের সন্ধ্যায় ধর্মতলার মোড়ের সিগন্যালের আলো লাল রং হতেই গতি থামল। কাঁধে বাক্স ঝোলান এক প্রৌঢ় লক্ষ্য রেখেছেন কোন কাঁচটা আগে খোলে। অপেক্ষা করতে হল না বেশিক্ষণ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়ির কাঁচ খুলে হাতের ইশারায় ডাক পেলেন। প্রৌঢ় হরেক রকম প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে এলেন। গাড়িতে বসে থাকা ভদ্রলোক কমলা রঙের তিনটি গুটখার প্যাকেট তুলে নিয়ে খুচরো পয়সা প্রৌঢ়ের হাতে ধরিয়ে দিলেন।
বৃষ্টি ভেজা বিকেলে রবীন্দ্র সদন মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক তরুণী। এক হাতে মোবাইল, অন্যটায় জ্বলন্ত সিগারেট। সুখটান শেষ করে এগিয়ে গেলেন নন্দনের দিকে।
বাস্তব শহরের মানুষের তামাক সেবনের এ রকম ছবি দেখালেও পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা।
পরিসংখ্যান বলছে, তামাকসেবন বিরোধী সচেতনতা কর্মসূচী কাজে এসেছে। কমেছে সিগারেট বিক্রি। বাস্তব আর পরিসংখ্যানের ফারাক কপালে ভাঁজ ফেলেছে চিকিৎসকদের একাংশের। তাঁদের আশঙ্কা সরকারি খাতায় ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ভাবে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি হচ্ছে না তো?
এক বেসরকারি সংস্থার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবর্ষ থেকেই সিগারেটের বাজার নিম্নমুখী। ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষের তুলনায় ৮.২ শতাংশ কম সিগারেট বিক্রি হয়েছে ভারতে।
চিকিৎসকদের অন্য এক অংশ জানাচ্ছেন, রাতারাতি তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তামাকজাত পণ্য সেবন যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর সেটা কিছু মানুষ যে বুঝতে পেরেছেন সে কথাও অস্বীকার করা যাবে না। তবে এই কর্মসূচীর আরও প্রসার ঘটাতে হবে এবং প্রশাসনকেও আরও সচেতন হতে হবে সে কথাও তাঁরা জানাচ্ছেন।
ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সিগারেট বিক্রি কম হলেই মুখ ও গলার ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা কমে যাবে এমনটা নয়। এটি একটি সুদূরপ্রসারী বিষয়। তবে সিগারেট বিক্রি কম হলে ভবিষ্যতে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা কমতে পারে এমনটা আশা করা যেতেই পারে। সরকারি হিসেবের বাইরেও সিগারেট বিক্রি হচ্ছে কী না সে দিকেও নজর দিতে হবে। প্রকাশ্যে সিগারেট ও গুটখা বিক্রি বন্ধ করতে প্রশাসনকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।’’
ক্যানসার চিকিৎসক সোমনাথ সরকার বলেন, ‘‘পরিসংখ্যান বলছে সিগারেট বিক্রি কমেছে। অর্থাৎ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হচ্ছেন মানুষ। তবে প্রশাসনকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। যাতে কোনও ভাবেই সরকারি হিসেবের বাইরে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি না হয়। মানুষের মুখ ও গলার ক্যানসারের চরিত্র বদলাচ্ছে। কারণ, টিউমারের গঠনগত চরিত্রের বদল ঘটছে। কেন এই বদল সেই নিয়ে পরীক্ষা করা জরুরি।’’ ইএনটি চিকিৎসক সৌরভ দত্ত বলেন, ‘‘সিগারেট বিক্রির নিম্নমুখী পরিসংখ্যান ক্যানসারের পরিসংখ্যানে প্রভাব ফেলবে সাত থেকে দশ বছর পরে। তবে অবশ্যই তামাকাসক্তের সংখ্যা কমলে ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যাও কমবে।’’
পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর ৭০ লক্ষ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। তার একটা বড় অংশ মুখ ও গলার ক্যানসারে আক্রান্ত। ফলে এই রোগের আক্রমণ কমাতে প্রশাসনের কড়া নজরদারি প্রয়োজন। এরই সঙ্গে ধূমপানে আরও কিছুটা রাশ টানতে পারলে পরিস্থিতি আরও ভাল হবে। মহারাষ্ট্র-সহ একাধিক রাজ্যে প্রকাশ্যে গুটখা বিক্রি আইন করে নিষিদ্ধ করা হলেও তা কিন্তু এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
নিষেধ-বিধি থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে প্রকাশ্যে বিকোচ্ছে সিগারেট ও তামাকজাত পণ্য? লালবাজারের এক পুলিশ কর্তা জানান, এত দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। প্রশাসন যথেষ্ট সক্রিয়। তামাকমুক্ত কলকাতা গঠনের চেষ্টা জারি রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy