দূরে থমকে মেট্রোর কাজ। পথের বাধা এই নির্মাণগুলিই। রাজারহাটে ছবিটি তুলেছেন সুমন বল্লভ।
পাঁচটি বাড়ির বিনিময়ে একশো কোটি।
এক কথায় বলতে গেলে, অঙ্কের সহজ উত্তর এটাই।
একটি ফ্ল্যাটবাড়ি, একটি স্কুল, দু’টি অতিথি নিবাস (গেস্ট হাউস) এবং একটি নির্মীয়মাণ গেস্ট হাউস। সব মিলিয়ে মেরেকেটে ৫০০ মিটার পথ। সেখানেই ওই পাঁচটি নির্মাণ অক্ষত রাখতে চান রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তাই নিউ গড়িয়া-বিমানবন্দর মেট্রো রেলের গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আর তাতেই খরচ হতে পারে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা।
মন্ত্রী বলেছেন। তাই নতুন রুট ঠিক করতে ‘রাইট্স’-কে সমীক্ষা করতে বলেছে মেট্রো। তবে ঘুরপথে লাইন গেলে প্রকল্প খরচ প্রায় ১০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি এবং বাড়তি সময় লাগার আশঙ্কার কথাও ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন মেট্রোকর্তারা। মন্ত্রী অবশ্য বলছেন, এটা নিছকই তাঁর ‘পরামর্শ’।
বিমানবন্দর থেকে নিউ টাউন, সল্টলেকের পাঁচ নম্বর সেক্টর হয়ে নিউ গড়িয়া যাবে এই মেট্রো। সেই মতো নিউ টাউনে নজরুল তীর্থের উল্টো দিকে প্রায় দেড় কিমি এলাকায় লাইন পাতার জন্য এলিভেটেড পথ তৈরির কাজও চলছে। কিন্তু টেকনোপলিসের আগে উড়ালপুলের প্রায় গা-ঘেঁষে আটকে গিয়েছে কাজ। কারণ, ওই পাঁচটি বাড়ি।
মেট্রোকর্তাদের বক্তব্য, উড়ালপুলের পাশে জমি লাগবে জানিয়ে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে নোটিস জারি করেন তাঁরা। তখন শুধু মহিষগোট প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দু’টি গেস্ট হাউস ছিল। বাকি দু’টির অস্তিত্ব ছিল না। ‘‘কিন্তু নোটিস পড়তেই অবৈধ ভাবে একটি ফ্ল্যাটবাড়ি ও গেস্ট হাউস তৈরি হতে থাকে। রাজ্য প্রশাসনকে বারবার বিষয়টি জানিয়েও লাভ হয়নি,’’ — দাবি মেট্রো-কর্তার।
কাজ থমকে আছে দেখে শেষমেশ মাস ছয়েক আগে রাজ্যের সঙ্গে বৈঠক করে মেট্রো। প্রকল্প নির্মাণকারী সংস্থা রেলওয়ে বিকাশ নিগম লিমিটেড (আরভিএনএল) এবং সরকারের কর্তাদের সঙ্গে জায়গাটি ঘুরে দেখেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। এর পরেই মুখ্যসচিবের ডাকা বৈঠকে তিনি জানান, বাড়িগুলি ভেঙে দেওয়া ঝামেলার। তার চেয়ে বরং প্রকল্পের গতিপথ ঘুরিয়ে দিক মেট্রো।
মন্ত্রীর এমন পরামর্শে হতবাক হয়ে যান মেট্রো কর্তারা। এক কর্তার দাবি, ‘‘এখনকার পথে লাইন পাততে বাড়িগুলির পুরোটা ভাঙা পড়বে না। সামনের দিকের কিছুটা অংশ হয়তো ভাঙতে হবে। ফ্ল্যাটবাড়ির ক্ষেত্রেও তাই। সেখানে সাকুল্যে তিন-চারটি পরিবারকে উঠে যেতে হবে। সে জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতেও প্রস্তুত। এ সব জেনেও খোদ মন্ত্রী পরামর্শ দেওয়ায় বাধ্য হয়েই রাইট্সকে বিকল্প পথের সন্ধানে সমীক্ষা করতে বলা হয়েছে।’’
কোনও ‘কারণ’ দেখিয়ে প্রস্তাবিত মেট্রোপথ বদলের ঘটনা এ রাজ্যে নতুন নয়। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো বা জোকা-বি বা দী বাগ প্রকল্পেও এমন ঘটেছে। সম্প্রতি জোকা প্রকল্পে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে জট কিছুটা কাটার পথে। মন্ত্রী বলেন, ‘‘মেট্রোকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, সম্ভব হলে গতিপথ বদলান। তাতে খরচ বাড়বে না, বরং কমবে। তা ছাড়া, দখলদার তুলতে গেলে অনেক হ্যাপাও পোহাতে হবে। গতিপথ বদল হলে সেই ঝামেলা থাকে না।’’
এই অবস্থায় রীতিমতো হতাশ মেট্রোকর্তারা। তাঁদের কথায়, পাঁচটি বাড়ি আংশিক ভাঙার বদলে নতুন পথ হলে শত কোটি টাকার বাড়তি বোঝা এবং সরকারের মনোভাব — দুইয়ের টানাপড়েনে প্রকল্পই না বন্ধ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে যে কাজ হয়ে গিয়েছে, তা ভস্মে ঘি ঢালা হবে।
নিউ গড়িয়া-বিমানবন্দর মেট্রোর জন্য যে কয়েকটি বাড়ি ভাঙা হতে পারে, তা জানেন স্থানীয় মানুষ। যেমন, সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক আশিস বিশ্বাস বলেন, ‘‘অনেক বারই মাপজোক হয়েছে। জেলাশাসক, মন্ত্রীও এসেছিলেন। আমাদের কাছে পরচাও চাওয়া হয়েছিল। ওরা জানিয়েছিল, স্কুলের বাইরের পাঁচিল এবং একটি ঘর ভাঙা পড়তে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানি না।’’
আবার নির্মীয়মাণ গেস্ট হাউসটির (যাকে বেআইনি বলছে মেট্রো) মালিক, মোহনবাগান ক্লাবের কর্মকর্তা বলরাম চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের তো মেট্রো কখনওই জানায়নি, ওই জমিতে মেট্রোর কাজ হবে। মেট্রোর নোটিস আমরা দেখেছি। তাতে আমাদের জমির দাগ নম্বর ছিল না। ফলে কাজ থামানোর প্রশ্নও ওঠে না।’’ বলরামবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘আইন মেনে জমি কিনেছি। আইন মেনেই গেস্ট হাউস তৈরি করছি।’’
সব মিলিয়ে জমি-ফাঁদে অনিশ্চিত নিউ গড়িয়া-বিমানবন্দর মেট্রোপথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy