Advertisement
২২ মার্চ ২০২৩
Trafficking

বার মাফিয়ার হাত দিয়ে কাদের কালো টাকা ব্যাঙ্ককে? তদন্তে ইডি

পানশালায় ভিড় হতে দেরি হয়নি। কারণ ঠিক সেই সময়তেই তৈরি হচ্ছে মেগাসিটি, আজকের নিউটাউন। লাফিয়ে বাড়ছে জমির দাম আর সেই জমির কারবার ঘিরে তৈরি হয়েছে এক দালাল শ্রেণি যাঁদের হাতে অগাধ কাঁচা টাকা।

রাজারহাটে বিষ্ণু মুন্দ্রার বাড়িতে ইডি-র তল্লাশি। নিজস্ব চিত্র।

রাজারহাটে বিষ্ণু মুন্দ্রার বাড়িতে ইডি-র তল্লাশি। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৮ ১৪:২৮
Share: Save:

আর পাঁচটা নিম্নবিত্ত পঞ্জাবি পরিবারের সঙ্গে কোনও ফারাক নেই। ভবানীপুরের ঘিঞ্জি গলিতে অনেকে মিলে বসবাস। কৈশোর পেরনোর আগেই বাড়ির ছেলেদের রোজগারের ধান্ধায় ভাগ্যান্বেষণ। সতেরো-আঠারো বছরের জগজিৎও তার ব্যতিক্রম ছিল না।

Advertisement

কৈশোর পেরোতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল কাজের খোঁজ। অন্যের লরি চালাতে চালাতেই নিজের লরি কেনা। ধীরে ধীরে সেই ব্যবসা আর একটু দাঁড়াতেই, খানিকটা ঝোঁকে পড়েই ভিআইপির ধারে কৈখালিতে এক টুকরো জমি কেনা। সেটা আশির দশকের শুরুর দিক। ভিআইপি রোডের ধারে অধিকাংশ জমিই জলাজমি নয়তো নিচু জমি। তাই দামটাও ছিল জলের দাম।

বাগুইআটি-কৈখালি এলাকার পুরনো বাসিন্দারা এখনও মনে করতে পারেন, ১৯৯৯ সালে ভিআইপির ধারে খোলা হয়েছিল ওই চত্বরের প্রথম পানশালা, ডাউনটাউন। সেই ছোট্ট পানশালা থেকে পরবর্তী দু’দশকে জগজিৎ সিংহের বার-ব্যারন হয়ে ওঠার কাহিনী সিনেমার থেকেও বেশি চমকপ্রদ। শুধু এই রাজ্যে বা দেশের একাধিক প্রান্তে নয়, দেশের সীমা ছাড়িয়ে সিঙ্গাপুরেও পানশালা ও হোটেলের ব্যবসা খুলেছিল জগজিৎ সিংহ, যে এই মুহূর্তে নারী পাচার ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে জেলবন্দি। এ বার তার বিরুদ্ধে কালো টাকা সাদা করে বিদেশে পাচারের অভিযোগও উঠল। সেই তদন্তে নেমে জগজিতের বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং তার দুই সঙ্গীর ফ্ল্যাটে দিনভর তল্লাশি চালালেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি)-র গোয়েন্দারা।

আরও পড়ুন: পানশালার আড়ালে নারী পাচার-বেটিং, কলকাতা জুড়ে তল্লাশি ইডি-র

Advertisement

কলকাতার পুরোন পানশালার মালিকরা অনেকেই এখনও বলেন, মুম্বইতে বার ডান্সিং-এ নিষেধাজ্ঞা ঝানু ব্যাবসায়ীর মত কাজে লাগিয়েছিল জগজিৎ। তখন ভিআইপি রোডের দু’ধারে পুলিশ বা প্রশাসনের নজরদারি ছিল যথেষ্ট কম। আর সেই সুযোগেই ডাউনটাউন হয়ে যায় কলকাতার উপকণ্ঠে প্রথম ডান্স বার।

বিষ্ণু মুন্দ্রার বাড়িতে ইডি-র আধিকারিকরা।

পানশালায় ভিড় হতে দেরি হয়নি। কারণ ঠিক সেই সময়তেই তৈরি হচ্ছে মেগাসিটি, আজকের নিউটাউন। লাফিয়ে বাড়ছে জমির দাম আর সেই জমির কারবার ঘিরে তৈরি হয়েছে এক দালাল শ্রেণি যাঁদের হাতে অগাধ কাঁচা টাকা। বাগুইআটির এক প্রোমোটার তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথাই শোনালেন, “তখন আমিও জমির দালালি করি। হাতে অনেক কাঁচা টাকা। আর সেই সঙ্গে হাতের কাছে এ রকম বিনোদন। আমার মত অনেকেই, জমির দালাল, উঠতি প্রোমোটার থেকে শুরু করে এলাকার নামী অপরাধী— সন্ধের পর সবার একটাই গন্তব্য—ডাউনটাউন।”

কয়েক বছরের মধ্যে ফুলে ফেঁপে ওঠে ডাউনটাউন। তরুণীদের শরীরী বিভঙ্গের তালে তালে উড়তে থাকে টাকা, যা জগজিতের হাত ঘুরে পৌঁছে যেত পুলিশ-প্রশাস থেকে রাজনৈতিক দলের কারও কারও কাছে। ওই এলাকার এক সময়ের এক দাপুটে সিপিএম নেতা, যিনি পরে দল বদল করেছেন, তাঁর সঙ্গে ‘সিংজি’র ঘনিষ্ঠতা এলাকার সবাই জানেন। তেমনই প্রশাসনের একটা বড় অংশই জানেন, পুলিশ মহলে জগজিতের ‘গড ফাদার’ এক পুলিশ কর্তার কথা। তিনি এক সময়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলেন। বর্তমানে সাসপেন্ড হয়ে আছেন।

আরও পড়ুন: সুয়োরানি অটো, বাস দুয়োরানি?

সেই পুলিশ কর্তার সৌজন্যে পুলিশ সবসময়ই বন্ধু ছিল এই পানশালা ব্যবসায়ীর। ডাউনটাউন থেকে এ বার জগজিতের উত্থানের পালা। ভিআইপির ধারে তখন ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে একের পর এক পানশালা। খালি ভিআইপি রোড নয়, ইএম বাইপাস, বর্ধমান, খড়্গপুর থেকে শুরু করে বিরাটি-বারাসত সব জায়গায় নতুন নতুন পানশালা খুলছে জগজিৎ।

কিন্তু হঠাৎ করেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। বিধাননগর কমিশনারেট চালু হওয়ার পরেও রাতভর খোলা থাকত তার সব পানশালা। ২০১৫ সালে জাভেদ শামিম বিধাননগরের কমিশনার থাকার সময় প্রথম বার তার পানশালায় শুরু হয় পুলিশি নজরদারি। সেই সময় একবার গ্রেফতার হলেও দ্রুত সামলে উঠেছিল। কিন্তু তারপরে ‘সিংজি’র এই রাজনৈতিক যোগাযোগই তার সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায়। শাসক দলের এক স্থানীয় নেতার দাবি, “জগজিতের কিছু রাজনৈতিক যোগাযোগের জন্য তিনি রাজ্যের এক শীর্ষ নেতার বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন।” তার পানশালার ব্যাবসার আড়ালে চলা দেহব্যবসা থেকে শুরু করে পঞ্জাব, হরিযানা থেকে কাজের টোপ দিয়ে আনা তরুণীদের ওপর যৌন নির্যাতন— যা আগে পুলিশের নজর এড়িয়ে যেত, তা প্রকাশ্যে আসা শুরু করে। তিনটি আলাদা মামলায় গ্রেফতার করা হয় তাকে, সঙ্গে ধরা হয়েছে তার সঙ্গী ব্যবসায়ী বিষ্ণু মুন্দ্রা এবং আজমল সিদ্দিকীকেও। বিষ্ণু পুলিশের খাতায় কুখ্যাত ক্রিকেট বুকি।

অভিযুক্ত জগজিত্ সিংহ ও বিষ্ণু মুন্দ্রা।

রাজ্য পুলিশের করা ওই তিনটি মামলার সূত্র ধরেই টাকা পাচারের মামলা শুরু করে তদন্ত করছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বৃহস্পতিবার জগজিতের ভবানীপুর ও সল্টলেকের বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে। ইডির গোয়েন্দারা হানা দিয়েছিলেন বিষ্ণুর লেকটাউন এবং রাজারহাটের ফ্ল্যাটেও। তল্লাশিতে তিনটি ল্যাপটপ-সহ বেশ কিছু নথি উদ্ধার হয়েছে।

ইডির তদন্তকারীদের দাবি, জগজিতের এই বিশাল পানশালার ব্যবসায়ে যে বিপুল পরিমাণ টাকা লগ্নি হয়েছে, তা পুরোটা তার নয়। রাজ্যের অনেক হোমড়া চোমড়া মানুষের কালো টাকা খাটছে জগজিতের ব্যবসায়। সেই টাকা সাদা করতে অধিকাংশ ব্যবসা লোকসানে চলছে এমনটাই দেখানো হয়েছে খাতায় কলমে। আর সেই টাকা পাচার হয়েছে বিদেশে। প্রাথমিক তদন্তের পর গোয়েন্দারা বিপুল সম্পত্তির হদিশ পেয়েছেন ব্যাঙ্ককে। নোটবন্দির পর পর ওই টাকা লগ্নি করা হয়েছে ব্যঙ্ককের হোটেল ব্যবসায়। এক ইডি কর্তার কথায়, “ওই টাকা আদৌ জগজিতের কি না সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের সন্দেহ, অন্য অনেকের টাকা পাচার হয়েছে জগজিতের হাত দিয়ে।” তল্লাশির পর এ বার জগজিতকে জেলেই জেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন গোয়েন্দারা।

এ দিকে জগজিতের ঘনিষ্ঠদের দাবি, ‘সিংজি’ মুখ খুললে নাকি তদন্তের পরিধি আরও বিস্তৃত হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.