Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

অন্য কাজের খড়কুটোই ভরসা জেসপ-কর্মীদের

বাড়ির বাগানের আম এ বার আর আত্মীয়-বন্ধুদের বিলি করেনি দমদম গোরাবাজারের মান্না পরিবার। সংসার চালাতে সেই আম বাজারে বিক্রি করেছেন তাঁরা। গৃহকত্রী রঞ্জনা মান্না রাঁধুনির কাজ নেওয়ার কথাও ভাবছেন। গত এক বছরে জীবনযাত্রা অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে এই পরিবারের। শুধু তাঁদেরই নয়, জীবনযাত্রা আমূল পাল্টে গিয়েছে দমদম ও তার আশপাশের এলাকার প্রায় ৬৫০টি পরিবারের।

আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৪ ০১:৩৬
Share: Save:

বাড়ির বাগানের আম এ বার আর আত্মীয়-বন্ধুদের বিলি করেনি দমদম গোরাবাজারের মান্না পরিবার। সংসার চালাতে সেই আম বাজারে বিক্রি করেছেন তাঁরা। গৃহকত্রী রঞ্জনা মান্না রাঁধুনির কাজ নেওয়ার কথাও ভাবছেন। গত এক বছরে জীবনযাত্রা অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে এই পরিবারের। শুধু তাঁদেরই নয়, জীবনযাত্রা আমূল পাল্টে গিয়েছে দমদম ও তার আশপাশের এলাকার প্রায় ৬৫০টি পরিবারের। নিরুপায় হয়ে কেউ নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করছেন, কেউ ধরেছেন রাজমিস্ত্রির কাজ, কেউ গয়না বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন, কেউ বা আত্মীয়স্বজনের আর্থিক সাহায্যেরই উপরেই পুরো নির্ভরশীল।

গত ন’মাস ধরে বেতন হচ্ছিল না দমদমের বন্ধ হয়ে যাওয়া জেসপ কারখানার কর্মীদের। কয়েক বছর ধরে বেশ কিছু বিভাগ বন্ধ। টিমটিম করে চলছিল কারখানা। তবু আশা ছিল সব ঠিক হয়ে ফের কাজ শুরু হবে ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই কারখানায়। কিন্তু গত ১৫ মে কর্তৃপক্ষ কারখানায় ‘সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক’ নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়ার পরেই সব আশা কার্যত শেষ। জেসপ কোম্পানি লিমিটেড ওয়ার্কার্স অ্যান্ড এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সম্পাদক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা চাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে সরকার এই কারখানা অধিগ্রহণ করুক। জেসপ বাংলার গর্ব। মুখ্যমন্ত্রী যদি উত্তরবঙ্গে চা-বাগান বাঁচাতে উদ্যোগী হতে পারেন, তা হলে জেসপ বাঁচাতে কেন নয়?’’

মান্না পরিবারের সনৎ মান্না জেসপের কোচ ওয়ার্কার্স বিভাগে কাজ করতেন। বেতন ছিল মাসিক ১২ হাজার টাকা। সনৎবাবু বলেন, ‘‘আমার বাবা জেসপে কাজ করে এই দোতলা বাড়ি করেছিলেন। আর আমি জেসপে কাজ করে ছেলের মুখে খাবারও তুলে দিতে পারছি না।’’ তাঁর স্ত্রী রঞ্জনাদেবী বলেন, ‘‘ছেলের নার্ভের অসুখ আছে। প্রতি মাসে ৪৫০ টাকার ওষুধ লাগে। সারা মাসের ওষুধ পর্যন্ত কিনতে পারি না। যে দিন ওষুধ খায়, সে দিন স্কুলে যায়।’’

দমদমের মানিকপুরের বাসিন্দা বলাকা আপ্পারাওদের বাড়িতে বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিয়েছেন বাড়িওয়ালা। আট মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। বলাকা আপ্পারাও কাজ করতেন জেসপের পেন্টিং বিভাগে। বললেন, ‘‘বাড়িওয়ালা বলেছেন আগামী মাসে যদি অন্তত পাঁচ মাসের ভাড়া দিতে না পারি, তা হলে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। কোথা থেকে এত টাকা পাব? ছেলের পড়া ছাড়িয়ে দিয়েছি। স্ত্রী রান্নার কাজ নিয়েছেন।” মাসে ১০ হাজার টাকার মতো বেতন পেতেন আপ্পারাও। এ ছাড়া, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং ইএসআই-এর সুবিধা তো ছিলই। তাঁর স্ত্রী মেরি বলেন, ‘‘সারা দিন ছেলে মেয়েরা খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে। এ রকম চললে আমাদের হয়তো শেষমেশ আত্মহত্যা করতে হবে।’’

জেসপের আর এক কর্মী প্রদীপ চক্রবর্তী অ্যাকাউন্টস বিভাগে সুপারভাইজার ছিলেন। বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকার মতো। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘গত ন’মাস ধরে ক্রমশ দেনার দায়ে ডুবে যাচ্ছি। স্ত্রী সোনার গয়না বন্ধক রেখেছেন। কিছু গয়না বিক্রি করেছি। মেয়ে অসুস্থ। সামনে পুজো। ছেলে-মেয়েদের জন্য জামাকাপড় কেনা দূরে থাক, ঠিক মতো মুখে খাবার পর্যন্ত তুলে দিতে পারছি না।’’

জেসপ ফের খোলার আশায় বসে থাকতে না পেরে তাই অন্য পেশায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কয়েক জন কর্মী। ড্রিলিং বিভাগের কর্মী জক্রু ওঁরাও রাজমিস্ত্রির কাজ শিখছেন। কেউ করছেন প্রাইভেট টিউশনি। এ ভাবে কত দিন চলবে জানা নেই কারওরই। শ্রীকুমারবাবু বলেন, ‘‘মাস কয়েক আগে গোপাল ছেত্রী নামে আমাদের এক সহকর্মী দেনার দায়ে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন। এতগুলো পরিবার সবাই আমরা খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jessop aryabhatta khan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE