দমকলের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষ। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
পাইপ আছে, পাম্প আছে। আছে জলাধারও। কিন্তু সোমবার এসএসকেএম হাসপাতালে আগুন নেভানোর সময়ে কি যথাযথ ভাবে কাজ করেছিল সেই পরিকাঠামো? এ দিন অগ্নিকাণ্ডের পরে ঘুরেফিরে এসেছে এই প্রশ্নটাই।
কারণ, আগুন নেভাতে এসে দমকলকে গোড়াতেই নিজেদের পাম্প চালু করতে হয়েছে এ দিন। পরপর পাইপ জুড়ে রোগীর পরিজন ও হাসপাতাল কর্মীদের হাতে হাতে তা পৌঁছে দিতে হয়েছে আগুনের কাছে। এমনকী দমকল পৌঁছনোর আগে হাসপাতাল কর্মী বা আশপাশের লোকজন অগ্নিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন সাধারণ ছোট ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার নিয়েই। আর সেখানেই প্রশ্ন উঠেছে— এসএসকেএমের হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ পরিকাঠামো যদি যথাযথই থাকে, তা হলে এই পরিস্থিতি হল কেন। দমকলের একাংশের বক্তব্যও তা-ই।
যদিও রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী তথা এসএসকেএমের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান অরূপ বিশ্বাস পরিকাঠামোর অভাবের কথা মানতে চাননি। এ দিন হাসপাতালেই তিনি বলেন, ‘‘সব কিছুই ঠিকঠাক কাজ করেছে।’’ এমনকী দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজেও বলেন, ‘‘সব কিছু ঠিকঠাক ছিল বলেই তাড়াতাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে।’’ তা হলে এই পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? উত্তর মেলেনি। দমকলের ডিজি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধু বলেন, ‘‘এ রকম খবর আমার জানা নেই।’’
আগুন লাগার খবর পেয়ে এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের সামনে পৌঁছন দমকলকর্মীরা। সাততলার উপরে জল দেওয়ার মতো পাম্প তাদের নেই। দমকলের এক অফিসার জানান, এই কারণেই বহুতলে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, হাইড্র্যান্ট রাখতে বলা হয়। এসএসকেএমে সে সব ব্যবস্থা আছে দেখে তাঁরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন। তড়িঘড়ি তাই বাড়িটির মোটা জলের পাইপের সঙ্গে নিজেদের সঙ্গে আনা পাইপ জুড়ে দেন। কিন্তু পাম্প চালু করতেই বোঝা যায়, সে সব কাজ করে না! দমকল সূত্রের খবর, সাততলার যেখানে আগুন লেগেছে, সেখানে কোনও স্মোক ডিটেক্টর, ফায়ার অ্যালার্মও ছিল না।
জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের বক্তব্য, রোনাল্ড রস বিল্ডিং-সহ এসএসকেএমের বিভিন্ন ভবনে ইচ্ছেমতো নির্মাণকাজ চলছে। তার জেরে নানা বিপত্তির তালিকায় নবতম সংযোজন এ দিনের অগ্নিকাণ্ড। তাঁদের দাবি, হাসপাতালের বিভিন্ন ভবন জতুগৃহে পরিণত হয়েছে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ করার পাশাপাশি বিদ্যুতের পুরনো ওয়্যারিং বদলানোর দাবিও তুলেছেন তাঁরা।
এ দিন হাসপাতালে গিয়ে অগ্নিসুরক্ষার খামতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ও। এসএসকেএম হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ জানান, হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলেও তার অনেকগুলিই অকেজো। সিঁড়িও অন্ধকার। বহু জায়গায় ছাদ থেকে বিদ্যুতের তার ঝুলে থাকে। এ দিন সাততলার লাইব্রেরি থেকে আগুন ওই তার ছুঁয়ে ফেললে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারত। কর্মীদের অনেকের দাবি, টানা এসি চলার ফলেও বহু সময়ে শর্ট সার্কিট হতে পারে। দমকল সূত্রের দাবি, এ দিন একেবারে উপরের তলায় আগুন লাগায় বড় বিপদ এড়ানো গিয়েছে। মাঝামাঝি কোনও তলায় আগুন লাগলে পরিস্থিতি সামলানো কার্যত অসম্ভব হতো। রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের অপরিসর, অন্ধকার সিঁড়ির কারণেও যে উদ্ধারকাজে সমস্যা হয়েছে, তা-ও মেনে নিচ্ছেন দমকলের অনেকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবশ্য ব্যাখ্যা, পুরনো দিনের ওই বাড়িতে সব আধুনিক ব্যবস্থা বসানো যায় না।
স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্রশঙ্কর শুক্ল এ দিন বলেন, ‘‘আমরা পূর্ত, পুলিশ ও স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে মিলে সব হাসপাতালের অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করছি।’’ কিন্তু এ কথা তো গত তিন বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে! কবে চালু হবে? স্বাস্থ্যসচিবের আশ্বাস, ‘‘শীঘ্রই চালু হবে।’’ এসএসকেএমের প্রতিটি বাড়িতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
এ দিন ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় আগুন নেভানোর পরেও দমকলের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ওঠে, হাইড্রোলিক মই কেন দ্রুত আনা হল না? দমকল দেরিতে আসার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। যদিও দেরিতে আসার অভিযোগ মানতে নারাজ দমকলকর্তারা। দফতরের নথি দেখিয়ে তাঁরা বলেন, ১১টা ২১ মিনিটে ডিজি কন্ট্রোলে ফোন গিয়েছিল। তার ৯ মিনিটের মধ্যে কালীঘাট দমকল কেন্দ্র থেকে প্রথম গাড়িটি পৌঁছয়। ধাপে ধাপে যায় ১৯টি গাড়ি ও ২টি হাইড্রোলিক মই। একটি মই বাবুঘাট এবং অন্যটি বেহালা থেকে আনা হয়েছিল।
অনেকের মতে, বছর পাঁচেক আগে বাইপাসের ধারে বেসরকারি আমরি হাসপাতালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, এবং সম্প্রতি বহরমপুর হাসপাতালে আগুনের ঘটনার পরেও কেন বড় হাসপাতালগুলিতে সর্বক্ষণের দমকল ইউনিট হয়নি, সেটাই বিস্ময়ের। প্রশ্ন উঠেছে, রোগীদের ভিড়ে ঠাসা এসএসকেএমে অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না? কেন আগুন নেভানোর চেয়ে এড়ানোর উপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে না? এসএসকেএমের কর্মীদের একাংশ বলছেন, তড়িঘড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে না এলে এ দিন আমরি বা বহরমপুরের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy