Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বাগ্‌দেবীর আরাধনাতেও হাজির নোট বাতিলের থিম

লক্ষ্মীর বিতর্ক এ বার শহরের সরস্বতী বন্দনাতেও! ছোট্ট মণ্ডপে বসে রয়েছেন বিদ্যার দেবী। দু’পাশে চার-চারটে এটিএম! মাথার উপরে খুচরো পয়সার মডেল দিয়ে সাজানো। এক টাকা, দু’টাকা, দশ টাকা— কী নেই সেখানে! পিছনের ব্যানারে উড়ছে পুরনো পাঁচশো, হাজারের নোট।

মণ্ডপে ‘নোটের চোট’ ।বুধবার ছবিগুলি তুলেছেন সুমন বল্লভ এবং সুদীপ্ত ভৌমিক।

মণ্ডপে ‘নোটের চোট’ ।বুধবার ছবিগুলি তুলেছেন সুমন বল্লভ এবং সুদীপ্ত ভৌমিক।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৩৫
Share: Save:

লক্ষ্মীর বিতর্ক এ বার শহরের সরস্বতী বন্দনাতেও!

ছোট্ট মণ্ডপে বসে রয়েছেন বিদ্যার দেবী। দু’পাশে চার-চারটে এটিএম! মাথার উপরে খুচরো পয়সার মডেল দিয়ে সাজানো। এক টাকা, দু’টাকা, দশ টাকা— কী নেই সেখানে! পিছনের ব্যানারে উড়ছে পুরনো পাঁচশো, হাজারের নোট। সেই টাকা ধরতে চাইছে কতগুলো হাত। লেখা রয়েছে, ‘বিনা অর্থ, অর্থই বীণা’।

এ তো নয় গেল বারোয়ারি পুজোর কথা। স্কুলের পুজোতেও এ বার থিমের রমরমা!

স্কুলের গেট পেরিয়ে হল ঘরের দিকে যেতেই করিডরের এক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ‘বিধুশেখর’। সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রোফেসর শঙ্কুর রোবট চরিত্রের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতেই দু’পাশে স্বাগত জানায় মহাকাশযান, ভিনগ্রহীরা। ঘরের ভিতরে দেবী সরস্বতী বসে রয়েছেন খোদ মহাকাশযানে। চার পাশে ছড়ানো গ্রহ, তারা, নক্ষত্র। সব মিলিয়ে শ্রীপ়ঞ্চমীতে অন্য রূপে বাগবাজার মাল্টিপারপাস স্কুল। অধ্যক্ষা হেনা সিদ্ধান্ত জানালেন, গত চার-পাঁচ বছর ধরেই স্কুলের পুজোয় থিম ঢুকেছে। এ বার বেছে নেওয়া হয়েছে বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানকে। ‘‘স্কুলের মেয়েরাই সবটা সাজিয়েছে। শিক্ষিকারা শুধু পাশে ছিলেন,’’ বলছেন হেনাদেবী।

বাগবাজার মাল্টিপারপাসকে জোর টক্কর দিতে পারে উত্তর কলকাতার বেথুন কলেজিয়েট, স্কটিশ চার্চ স্কুলও। মিশনারি স্কুল স্কটিশ চার্চে গত কয়েক বছর ধরে পুজো শুরু হয়েছে। এ বার স্কুল চত্বরে পা ফেলতেই চোখ কেড়ে নিয়েছে সাদা-কালো আলপনায় ফুটে ওঠা ‘সহজপাঠ’। স্কুলপড়ুয়াদের হাতেই রূপ পেয়েছে সেই আলপনা। এবং মেঝেতে আঁকা কবিতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেওয়ালে টাঙানো সহজপাঠের ছবিও এঁকেছেন ছাত্ররাই। স্কটিশ চার্চ স্কুলের বাংলার শিক্ষক সৌমিক দত্ত বলছেন, ‘‘সারা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাতৃভাষা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। ভাষার শিকড় ধরে রাখতেই এ বছরের এই পরিকল্পনা।’’ একাদশ শ্রেণির রোহিতকুমার ঘোষের আক্ষেপ, ‘‘ছোটবেলায় কত মজা করে সহজপাঠ পড়েছি। আমাদের ভাইবোনেরা তো আর সে সব পড়ে না।’’

বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে ‘সেকেলে’ রিকশা। বুধবার ছবিগুলি তুলেছেন সুমন বল্লভ এবং সুদীপ্ত ভৌমিক।

বেথুনে ঢুকতেই নজর কাড়বে হাতে টানা রিকশা! ঐতিহ্যের থিমের বাহন হিসেবেই যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে শহর কলকাতার ‘সিগনেচার’ এই যান! তবে আসল নয়, থার্মোকল দিয়ে তৈরি। ভিতরে ছোট মাপের ট্রাম, শহিদ মিনার, টাউন হল। কিন্তু ডাকের সাজে দেবীমূর্তিও যেন সেই ঐতিহ্যের থিমেই বাঁধা। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা শাশ্বতী অধিকারী বলছেন, ‘‘আমাদের মেয়েরা নিজেরাই এই ‘হেরিটেজ’ থিম সাজিয়ে তুলেছে।’’

থিম না হলেও দমদমের কিশোর ভারতী স্কুলের সরস্বতী পুজোয় এ বার রয়েছে ছোটদের ঝুমঝুমির সাজ। তবে থিম রয়েছে তাদের প্রদর্শনীতে। সরস্বতী পুজো উপলক্ষে পড়ুয়াদের নিয়ে বার্ষিক প্রদর্শনীর থিম এ বার ‘বাঙালির বিজ্ঞান সাধনার সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা’। স্কুলের শিক্ষক পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা থেকে বর্তমান, এই সময়কালের ইতিহাসই তুলে ধরেছি আমরা।’’

স্কটিশে যেমন সহজপাঠ, তেমনই এন্টালির বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের মণ্ডপে এ বার উঠে এসেছে শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত, শ্রীনাথ বহুরূপীরা। গত কয়েক বছর ধরেই অবশ্য সরস্বতী পুজোয় হাত পাকিয়েছে এই ক্লাব। কখনও তারা তুলে ধরেছে রবীন্দ্রনাথকে, কখনও স্বামী বিবেকানন্দ বা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে। ক্লাব সদস্য অঙ্কন কুমার জানান, তাঁদের মাথাতেই এসেছিল থিম ভাবনা। তা ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী রণজিৎ ধর।

স্কুলপড়ুয়াদের এমন থিম ভাবনা এবং মণ্ডপসজ্জার তারিফ করছেন শহরের বিভিন্ন নামী পুজোশিল্পীও। উৎসব কাপের ময়দানে নামার আগে তাঁদের অনেকেই তো সরস্বতী পুজো দিয়েই হাত পাকিয়েছিলেন। শিল্পী অনির্বাণ দাস আজও মেদিনীপুরের পুরনো পাড়ার সরস্বতী পুজোর মণ্ডপসজ্জার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তাঁদের মতে, সরস্বতী পুজোয় অল্পবয়সিরাই যুক্ত থাকেন। এমন কাজ তাঁদের শৈল্পিক ভাবনা, মনন গড়ে দেয়।

কে বলতে পারে, এই পড়ুয়াদের কেউ কেউ-ই আগামী দিনে শহরের দাপুটে পুজোকর্তা কিংবা উৎসব কাপের তারকা হয়ে উঠবে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE