Advertisement
০২ মে ২০২৪
শ্যামপুকুর

বিপদে-আপদে আজও পাশে দাঁড়ানোর লোক মেলে

তেলিপাড়ার এই বাড়িতে আছি ’৯৭-এর শেষের দিক থেকে। আমরা ওপার বাংলার মানুষ। এখানে আসার পরে শ্যামপুকুর এলাকারই বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি। আগে থাকতাম আনন্দ লেনে। শ্যামপুকুর স্ট্রিট, বলরাম ঘোষ স্ট্রিট, রামধন মিত্র লেন, তেলিপাড়া লেন, খানিকটা শ্যামবাজার স্ট্রিট, কিছুটা রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট— পুরোটা জুড়েই আমার পাড়া।

গণেশ বেদজ্ঞ
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৫ ০০:২১
Share: Save:

তেলিপাড়ার এই বাড়িতে আছি ’৯৭-এর শেষের দিক থেকে। আমরা ওপার বাংলার মানুষ। এখানে আসার পরে শ্যামপুকুর এলাকারই বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি। আগে থাকতাম আনন্দ লেনে। শ্যামপুকুর স্ট্রিট, বলরাম ঘোষ স্ট্রিট, রামধন মিত্র লেন, তেলিপাড়া লেন, খানিকটা শ্যামবাজার স্ট্রিট, কিছুটা রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট— পুরোটা জুড়েই আমার পাড়া।

আমার পাড়া নিয়ে বলতে গেলে স্বভাবতই আসে আমাদের কালের সে সব রঙিন দিনের কথা। আমাদের সময়ে পড়াশোনার এত চাপ ছিল না। ইচ্ছেমতো ঘুড়ি ওড়াতাম, চাকা চালাতাম। এখানে শৈলেন্দ্র সরকার, শ্যামবাজার এ ভি, টাউন স্কুল বা সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয়— সব মিলিয়ে স্কুল আছে প্রায় খান ছয়েক। আর কলেজ বলতে পাশেই আছে জয়পুরিয়া। তাই প্রতিনিয়তই রাস্তাঘাটে চোখে পড়ে স্কুলব্যাগ কাঁধে অগুনতি ছেলেমেয়েদের। ওদের পড়াশোনার চাপ আর ব্যস্ততা দেখে মনে হয় যেন সকলেই দৌড়চ্ছে। থিতু হওয়ার সময় কোথায়?

আগেকার দিনে মানুষের জীবনযাত্রায় অর্থনৈতিক ভাবে হয়তো তেমন সচ্ছলতা ছিল না, কিন্তু জীবনের গতিটা ছিল সরল। রাজনীতির বিষ এত বেশি করে মানুষের জীবনে ছড়িয়ে পড়েনি তখনও। পাড়ায় মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ছিল। তার পরে এল রাজনীতির মতভেদ। আসলে ভিতরটাই তো মানুষকে চালনা করে। সেটা বদলে গেলে, বাইরেটাও বদলাতে বাধ্য। পাড়ার বাইরের দিকে বদল এসেছে খানিক। এই যে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, সেখানে একটা বড় মাঠ ছিল। খেলতে যেতাম সকলে মিলে। এখন তো প্রোমোটারদের হাতে প়ড়ে বড়় বড় বাড়ি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে যত্রতত্র। আসলে এই সব পুরনো বাড়িগুলো ঠিকমতো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না সব সময়ে। আর ফ্ল্যাটবা়ড়ি হলে লোকজনের থাকার জায়গাও বাড়বে। তবে তেলিপাড়া লেনের ভিতরের দিকে বেশ কিছু পুরনো বাড়ি এখনও অক্ষত আছে। বেশির ভাগ একান্নবর্তী পরিবারও ভাঙছে এখন। ফলে মানুষে মানুষে দূরত্বও বাড়ছে। তবে এই এলাকায় সবুজের পরিমাণ কিন্তু বেশ অনেকটাই। এ বারের ঝড়ে একটা বড় বট গাছ পড়ে গেল ঠিকই, তবে আশপাশে তাকালে প্রচুর সবুজ গাছ-গাছালি দেখা যায়।

প্লেটো বলেছিলেন, ‘বাই দ্য পাস্ট থ্রু দ্য প্রেজেন্ট টু দ্য ফিউচার’। তাই আমার পাড়া দেখতে গেলে ফিরে তাকাতে হবে পুরনো সেই সব দিনে, যেখানে পরতে পরতে মিশে আছে ঐতিহ্য আর মহান সব মানুষের নিবাস। সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষা, অভিনয় থেকে শুরু করে রাজনীতি হয়ে খেলাধুলা, সব ক্ষেত্রেরই এক মহান মিশেল এখানে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য— সকলেরই বাস ছিল শ্যামপুকুরে। এখানকারই বাসিন্দা সঙ্গীতশিল্পী যূথিকা রায় যাঁকে মুম্বইয়ের মীরাবাঈ বলা হত, তিনি স্বাধীনতা উৎসবের প্রথম প্রভাতে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। বিখ্যাত সব নাট্যব্যক্তিত্বদের উত্থানও এখানেই। শ্যামপুকুরে আছে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়াও। এখানেই আছে সারদেশ্বরী আশ্রম। ১৮৮৫ সালে শ্যামপুকুর বাটীতে এসে প্রায় ৭০ দিন থেকে গেছেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ। আছে আদিনাথ আশ্রমও।

প্রাক্তন মেয়র কমল বসুর বাড়িতে তৈরি হয়েছিল মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব। সেই এক ইতিহাসের শুরু, যা আজও প্রবহমান। খেলাধুলাটা তো এখানকার মানুষদের রক্তে। এখনও লাহা কলোনির মাঠে বা পাড়ার মোড়ে ছেলেরা ফুটবল-ক্রিকেট খেলে। সেভেন স্টার ও অভিযান নামে দু’টো ক্লাব আছে এখানে। পাড়ার ক্লাবগুলো নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে। বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। এ ছাড়া গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডার চলটা তো বহু পুরনো। এখন শুধু আড্ডা নয়, ক্লাবগুলোয় টিভি লাগিয়ে ক্যারামও খেলা হয়। পাড়ায় নানা অনুষ্ঠানে মাইক চলে বেশি রাত অবধি। বহু নিষেধ সত্ত্বেও কাজ হয় না তেমন।

শ্যামপুকুর স্ট্রিট, আনন্দ লেন এবং শ্যামপুকুর থানার পাশে বস্তি আছে অনেকগুলো। তবে সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রার মানও ইদানীং বেড়েছে। এমনিতে পাড়াটা শান্তিপূর্ণ। দু’-একটা যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে না, তেমন নয়। তবে তা নিতান্তই পাড়ার কিছু ছেলেদের সমস্যা থেকে। পরে নিজেরাই সব মিটিয়ে নেয়। সত্যি কথা বলতে কী, নিরাপত্তার কথাও সে ভাবে ভাবতে হয়নি কোনও দিন। পাশেই তো শ্যামপুকুর থানা।

সাধারণ মানুষদের জন্য এখানে চালু হয়েছিল শ্যামপুকুর পল্লিমঙ্গল সমিতি ও কম্বুলিয়াটোলা দরিদ্র ভাণ্ডার। কম টাকায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসার সুবিধার্থেই এই উদ্যোগ ছিল। এখন মানুষদের হাতে টাকা বেশি কিনা জানা নেই ঠিক, তবে কেউ আর এ সব জায়গায় তেমন ভাবে চিকিৎসা করাতে আসেন না। মনে আছে সপ্তাহে দু’দিনে এক সময়ে আমি ২০০-৩০০ জন রোগী দেখতাম। আর গত সপ্তাহে সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে তেরোয়। তবে ১৮৯২ সাল থেকে শ্যামপুকুরের ক্যালকাটা অরফ্যানেজ পথশিশুদের কল্যাণে কাজ করে চলেছে।

পৃথিবীটা তো ব্যুফে সিস্টেমে চলে। তাই সবাইকে খেতে হলে ঘুরে-ফিরে এখানে আসতেই হবে। উত্তর কলকাতার ঐতিহ্য বজায় রেখে এখানে অলি-গলিতে যেমন চপ-মুড়ি-শিঙাড়া বা রোল-চাউমিনের দোকান আছে প্রচুর, তেমনই হালফিলে কিছু নামী রেস্তোরাঁও গড়ে উঠেছে। আর মধুরেণ সমাপয়েৎ করতে গেলে আসতেই হবে এখানকার বিখ্যাত সব মিষ্টির দোকানে।

শ্যামপুকুর স্ট্রিটে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের পুরনো বাড়ির সামনে, রামধন মিত্র লেনে এবং লাহা কলোনির মাঠে পুজো হয়। তবে মনে হয় পুজোয় সেই আনন্দের রং বদলেছে অনেকটা। আগেকার মতো সেই আন্তরিকতা আর নেই কোথাও। আগে সংস্কৃতি চর্চার মান ছিল উন্নত। এখন বোধ হয় লঘু চিন্তাভাবনার জন্যই চারদিকে অপসংস্কৃতি অনেক বেশি।

আমার মনে হয় আমাদের নিজেদের দেখার দোষেই সমস্ত কিছু দোষী হয়। এলাকা নিয়ে তেমন কোনও অভিযোগ আমার নেই। বর্ষাকালে একটু-আধটু জল জমে ঠিকই, তবে কর্পোরেশন সাধ্যমতো চেষ্টাও করে। জল জমলেও তা বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না।

শুধুমাত্র তেলিপাড়ায় ঢোকার মুখে, উল্টো দিকে আছে একটি খোলা ভ্যাট। বহু বছর ধরে একই ভাবে পড়ে আছে। কোনও দিনও সরানো হয়নি সেখান থেকে। তাই আর ইদানীং প্রতিবাদও করা হয় না।

সর্বোপরি এটাই বলব, এক জন মানুষের বেড়ে ওঠার জন্য এবং সত্যিকারের মানুষ হতে গেলে যে ধরনের পরিবেশ দরকার, সেই শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির জোগান দেয় এই শ্যামপুকুর। তাই পাড়া নিয়ে আমার গর্ব কম নয়।

লেখক বিশিষ্ট চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE