ধর্মতলার সুরশ্রী অর্কেস্ট্রা। রাধাকান্ত নন্দী, নবীন চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে সেখানেই প্রথম দেখেছিলাম বনশ্রীদিকে। অনেক কাল আগের কথা। ছিপছিপে, বড় বড় চোখ। সেই থেকে আলাপ। সেই থেকে দিদি।
১ ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পুজোর দিন শেষ দেখা। আমার বাড়িতে বেশ বড় করেই পুজোর আয়োজন করি। আগে বেশ কয়েক বছর বনশ্রীদিকে বলেছিলাম। কখনও এসেছে, কখনও আসেনি। এ বছর আর বলিনি। হঠাত্ সে দিন দেখি নিজেই এসে হাজির। আমি তো অবাক। বলে উঠলাম, ‘‘এ কি তুমি!’’ বনশ্রীদি বলেছিল, ‘‘পুজোর দিন। কেউ কাছে নেই। বোনেরাও আসেনি এ বছর। খুব একা লাগছিল। ভাবলাম যাই, হৈমন্তীর বাড়ি ঘুরে আসি।’’ অনেকক্ষণ বসে থাকল। গল্প করল। তবে খেল না কিছু। বলল, তুই আমাকে খাবার বেঁধে দে। নিয়ে যাব। সেই মতোই ব্যবস্থা করে দিলাম। আমার ড্রাইভার গিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে এল।
আসলে জীবনে এমন দিন আসবে আমরা সকলেই জানি। প্রিয়জনেরা চলে যাবে একে একে। কিন্তু দিনটা এসে পড়লে মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়।
আরও পড়ুন, প্রয়াত বনশ্রী সেনগুপ্ত
আজ বরং শেষ থেকে শুরু করি। সরস্বতী পুজোর কথা বললাম। তার আগে দেখা হয়েছিল বাংলা সঙ্গীত মেলায়। এ বছর জানুয়ারিতেই বোধহয়। দিদির গলাটা আর সঙ্গ দিত না শেষ দিকে। সে দিন স্টেজে গাইতে উঠেছেন। আমি বসেছিলাম উইংসের পাশে। বুঝতে পারছি গাইতে কষ্ট হচ্ছে। হঠাত্ই আমার দিকে তাকিয়ে বেশ রেগেই বলে উঠল, ‘‘দেখছিস না দিদি গাইতে পারছে না, বসে আছিস!’’ এটা শুনেই আমি দৌড়ে চলে গেলাম স্টেজে। এই বয়সে যতটা দৌড়ে যাওয়া যায় আর কী। একসঙ্গে গাইলাম ‘আমার অঙ্গে জ্বলে রংমশাল।’
শান্তি দা মানে ওঁর হাজব্যান্ড চলে যাওয়ার পর খুব একা হয়ে গিয়েছিল বনশ্রীদি। আসলে শান্তিদার ওপর ভীষণ নির্ভরশীল ছিল তো। ওর মতো এত সরল মানুষ আর দেখিনি আমি। পশ্চিমবঙ্গে বনশ্রী সেনগুপ্তর মতো এত অনুষ্ঠান আর কোনও আর্টিস্ট করেছেন কিনা সন্দেহ। এক দিনে তিনটে-চারটে অনুষ্ঠান একটা সময় বাঁধা ছিল।
সেই সুরশ্রী অর্কেস্ট্রায় সে সময় রবীন চট্টোপাধ্যায় আমার মতো নতুনদের সঙ্গে বনশ্রীদির আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। সকলকে ডেকে ডেকে বলতেন, চুঁচুড়া থেকে একটি মেয়ে এসেছে। ভারী সুন্দর গলা। ‘অবশেষে’ নামের একটি ছবিতে প্রথম বনশ্রীদির সঙ্গে গান গেয়েছিলাম। কী গান ঠিক মনে নেই। তবে ও লিড গেয়েছিল, আমি কোরাসে ছিলাম। সেই থেকে ছোট বোনের মতই দেখত আমাকে। এখানে যাবে না, ওটা করবে না…।
শুধু এক একটা সময় রেগে যেত বনশ্রীদি। অবশ্য আমিই খুনসুটি করে রাগিয়ে দিতাম। বিখ্যাত এক সিনিয়র মিউজিশিয়ান ছিলেন প্রতাপ রায়। গানের জগতে সকলে জানেন ওঁর কথা। সে সময় বনশ্রীদির অনুষ্ঠান মানেই প্রতাপদা যাবেন। ধরুন, আমিও গিয়েছি অনুষ্ঠানে গান গাইব। স্টেজে উঠে প্রতাপদাকে ডেকে নিতাম। তখন বনশ্রীদি রেগে গিয়ে বলত, ‘‘আমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তোর সঙ্গে বাজাবে কেন রে?’’ তবে এ ছিল নিছকই মজা।
মান্নাদার সঙ্গে খুনসুটি করতাম আমরা। বনশ্রীদি বলতেন, ‘‘মান্নাদা আপনি খালি হৈমন্তীকে গান দেন, আমাকে দেন না।’’ কী সব ছিল সেই দিন…!
বিভিন্ন রোগে কষ্ট পাচ্ছিল বনশ্রীদি। কিন্তু খবরটা পাওয়ার পরই সেই মিষ্টি হাসিটা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ১৯৮২-তে রেকর্ড হওয়া ওঁর গান, ‘কেন মন কেমন কেমন…।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy