Advertisement
E-Paper

ত্রুটি লুকিয়ে ঝালাই করেই কি বিপর্যয়? প্রশ্নটা উঠছেই

বৃহস্পতিবার বারবেলায় কলকাতার বুকে যে উড়াল পুলটি ভেঙে পড়ল, সেটি ইস্পাতের তৈরি। তার কাঠামো (স্ট্রাকচার) বাক্সের মতো দেখতে। সেই বাক্স আগে থেকে ইস্পাতের পাত জুড়ে তৈরি করে এনে লাগানো হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভাষায় একে ‘প্রি ফ্র্যাব্রিকেটেড বক্স সেকশন’ বলা হয়। যা দেখা গিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, বক্সগুলি তৈরি করা হয়েছিল ঝালাই (ওয়েল্ডিং) করে।

অলোক সরকার

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪০

বৃহস্পতিবার বারবেলায় কলকাতার বুকে যে উড়াল পুলটি ভেঙে পড়ল, সেটি ইস্পাতের তৈরি। তার কাঠামো (স্ট্রাকচার) বাক্সের মতো দেখতে। সেই বাক্স আগে থেকে ইস্পাতের পাত জুড়ে তৈরি করে এনে লাগানো হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভাষায় একে ‘প্রি ফ্র্যাব্রিকেটেড বক্স সেকশন’ বলা হয়। যা দেখা গিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, বক্সগুলি তৈরি করা হয়েছিল ঝালাই (ওয়েল্ডিং) করে।

ব্রিজটি এক-এক জায়গায় এক-এক রকম চওড়া। যার ফলে গার্ডারের সংখ্যাও এক-এক জায়গায় এক-এক রকম। কোথাও আট, তো কোথাও ছয়। ব্রিজকে ধরে রাখতে এই গার্ডার অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িতে ছাদকে ধরে রাখতে যেমন বিম জরুরি, তেমনই গার্ডার ছাড়া ব্রিজ তৈরিই সম্ভব নয়। ব্রিজের স্তম্ভ (পিলার বা কলম) এবং গার্ডার দেখে মনে হয়েছে, সেগুলি যথেষ্ট শক্তিশালী। সেখানে কোনও গলতি থাকার জন্য এই দুর্ঘটনা ঘটেনি বলেই মনে হয়। কিন্তু তা হলে এমন ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল কী ভাবে?

ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেল যে, রাত বারোটা-সাড়ে বারোটা থেকে ব্রিজের পাটাতন (ডেক) ঢালাই শুরু হয়েছিল। এটি সেই অংশ, যার উপর দিয়ে যানবাহন চলে। ঢালাইয়ের কাজ চলেছিল সকাল সাড়ে ছ’টা-সাতটা পর্যন্ত। এর পর দুপুর বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ প্রায় একশো মিটারের মতো ব্রিজের পাটাতন ভেঙে পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এ ভাবে তা হঠাৎ ভেঙে পড়ার কারণ কী? তা-ও আবার আগের দিনই ঢালাইয়ের পরে এবং কোনও গাড়ি চলাচলের আগেই। তা হলে কি ব্রিজ ঢালাইয়ের ওজন ধরে রাখতে পারল না?


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন:

ব্রিজ ঢালাইয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা কয়েক জন কর্মীর সঙ্গে কথা হল। তাঁরা খুব অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন। কয়েক জন কর্মীর দাবি, ঢালাইয়ের আগেই নাকি বেশ কয়েকটি নাট-বোল্টে ত্রুটি ধরা পড়ে। হয় সেগুলি ভাঙা ছিল কিংবা ঢিলে। ঘটনাস্থলে নির্মাণের দায়িত্বে থাকা কেউ-কেউ নাকি তখনই ঢালাই বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের কাছে সম্ভবত নির্দেশ এসেছিল যে, তা কোনও মতেই করা চলবে না। কারণ, তাতে সময় এবং অর্থ দু’য়েরই অপচয় হবে। ওই কর্মীদের দাবি, ত্রুটিপূর্ণ নাট-বোল্টগুলিই ঝালাই করে বসিয়ে দিতে বলা হয় তাঁদের। এর উপরেই কংক্রিটের ঢালাই করা হয়।

অথচ নাট-বোল্টে ত্রুটি ধরা পড়লে সেগুলি একেবারে পাল্টে দেওয়াটাই নিয়ম। ওই কর্মীরা বলছেন, তা তো হয়ইনি, উল্টে খারাপ নাট-বোল্টগুলি ঝালাই করে বসিয়ে দিতে বলা হয়েছিল। নাট-বোল্ট তো ঝালাই করারই কথা নয়!

সত্যি বলতে, ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এই ঘটনা বিশ্বাস করতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। সেতুর কোন অংশে এই ভাবে নাট-বোল্ট ঝালাই করা হয়েছে, কোনও নাট-বোল্ট খুলে গিয়েই বিপত্তি ঘটেছে কি না, সে সব তো এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে এই কথা সত্যি হলে তা অমার্জনীয় অপরাধ।

আরও পড়ুন:
দাগি সংস্থাকেই সেতু তৈরির ভার! ২৩ প্রাণের মাসুল দিল মহানগর

আমার পড়াশোনা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। আজকের ঘটনা দেখে নিজের ছাত্রজীবনের একটি স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। ১৯৮০ সাল। তখন আমি নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই সময় কানসাস সিটিতে একটি বিরাট মাপের নাচের ফ্লোর ভেঙে পড়ায় মারা যান ১০০ জনেরও বেশি মানুষ। পরে তদন্তে দেখা গিয়েছিল যে, গলদ রয়েছে সেই ফ্লোর ধরে রাখার জয়েন্টেই। তাতে খুঁত থাকায় পুরো ফ্লোরই ধসে পড়েছিল। এ ক্ষেত্রেও সেই একই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

যে সমস্ত রড, সিমেন্ট, ইস্পাত ইত্যাদি দিয়ে কলকাতার এই ব্রিজ তৈরি, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট এখনও জানা যায়নি। ফলে একেবারে নিশ্চিত করে হয়তো কোনও কিছু বলা সম্ভব নয়। কিন্তু দেশে-বিদেশে ব্রিজ তৈরিতে নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, খামতি থেকে থাকতে পারে আরও বেশ কয়েকটি জায়গাতেও। বারবার প্রশ্ন জাগছে, এই ব্রিজ তৈরিতে নিম্ন মানের মালমশলা ব্যবহার করা হয়নি তো? নয়তো তা এ ভাবে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল কী ভাবে? কেমনই বা ছিল তৈরির সময় তার দেখভাল (সুপারভিসন)? সেখানে যদি খুঁত না থাকত, তবে এত বড় ঘটনা চট করে ঘটত কি? প্রশ্নচিহ্ন থেকে যাচ্ছে ব্রিজের নকশা নিয়েও।

আমার মনে হয়, এই সমস্ত বিষয়গুলি বিশেষজ্ঞদের খতিয়ে দেখা উচিত। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না-ঘটে, তার জন্য সবার আগে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বার করা জরুরি। তার ভিত্তিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক সরকার ও প্রশাসন। আর যা-ই হোক, দোষীরা যেন ছাড় না পায়।

(লেখক স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, ব্রিজ-বিশেষজ্ঞ, এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক)

Tragedy Kolkata Flyover Collapse MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy