Advertisement
২৭ জুলাই ২০২৪

‘সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে ছেলেটা হয়তো বেঁচে যেত’

টালির বাড়িটার সদর দরজা পেরোলেই এক দিকে চাতাল, অন্য দিকে খোপের মতো পরপর ঘর। সেই ঘর লাগোয়া উঠোনে কাপড় কাচছিলেন এক মহিলা। এটাই সোনু যাদবের বাড়ি?

বুকভাঙা: মৃত ছেলের ছবি আঁকড়ে লক্ষ্মীদেবী। একবালপুর লেনের বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র

বুকভাঙা: মৃত ছেলের ছবি আঁকড়ে লক্ষ্মীদেবী। একবালপুর লেনের বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৯ ০২:১৪
Share: Save:

মোবাইল ফোনের নোটিফিকেশন দেখাচ্ছে, তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রির আশপাশে! চড়া রোদে একবালপুর লেনে একটি বাড়ি খুঁজে বার করায় যিনি সঙ্গী হয়েছেন, সেই মহম্মদ জাফর স্থানীয় বাসিন্দা। গলি, তস্য গলি পেরিয়ে যে টালির বাড়ির সামনে তিনি দাঁড় করালেন, পাড়ার বাসিন্দাদের কাছে সেটি ‘ক্রিকেটারের বাড়ি’ নামেই পরিচিত। গরম কেমন? পথ চিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ে জাফরও হিন্দিতে বলছিলেন, ‘‘খুব গরম। এই গরমেই তো ওই ক্রিকেটারের মৃত্যু হল!’’

টালির বাড়িটার সদর দরজা পেরোলেই এক দিকে চাতাল, অন্য দিকে খোপের মতো পরপর ঘর। সেই ঘর লাগোয়া উঠোনে কাপড় কাচছিলেন এক মহিলা। এটাই সোনু যাদবের বাড়ি? প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত কোনও শব্দ বেরোলো না মহিলার মুখ থেকে। এর পরে সাবানজল ভরা গামলায় হাত ছুড়ে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, ‘‘আমার বেটা, ক্রিকেটার সোনু যাদবের বাড়ি এটাই!’’

গত ২০ মার্চ সকালে একবালপুর লেনের এই ৪২/এইচ/৪০ নম্বর বাড়ি থেকে বেরিয়েই ময়দানের বাটা মাঠে ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলেন বছর বাইশের সোনু। প্রবল গরমে ব্যাট করতে নেমে আউট হয়ে ফিরে আসার সময়েই পড়ে যান তিনি। চোখে-মুখে ঠান্ডা জল দিয়ে কোনও মতে তাঁকে সুস্থ করার চেষ্টা হলেও ফের মাঠে পড়ে যান বালিগঞ্জ স্পোর্টিংয়ের (দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাব) এই খেলোয়াড়। আর ওঠেননি। ট্যাক্সিতে তাঁকে সিএবি-র মেডিক্যাল ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সিএবি-র অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে পাঠানো হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। তাঁর সহ-খেলোয়াড়েরা জানাচ্ছেন, তত ক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। সোনুকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।

সে দিনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সোনুর মা লক্ষ্মীদেবী বললেন, ‘‘এত গরমের মধ্যে খেলা হচ্ছিল। কিন্তু কেউ অসুস্থ হলে কী করা হবে, তার কোনও ব্যবস্থা ওই মাঠে ছিল না। একটা অ্যাম্বুল্যান্স থাকলে তাতে করে সঙ্গে সঙ্গে সোনুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যেত। সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে ছেলেটা হয়তো বেঁচে যেত।’’ কান্নায় ভেঙে পড়া লক্ষ্মীদেবীর অবস্থা দেখে সোনুর ভাই অমরজিৎকে তখন ফোন করেছেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীরা। অমরজিৎ ফোনে বললেন, ‘‘ভাইয়ের জন্য কোনও সাহায্য পাইনি আমরা। ও যে ক্লাবে খেলত, সেখানকার কয়েক জন ছাড়া কেউ দেখা করতেও আসেননি। আমার ভাই বিহারে প্রথম ডিভিশনের খেলোয়াড় ছিল। তার পরিবারের কথা কেউ ভাবেননি। এখনও তো এই গরমের মধ্যেই ময়দানে খেলা চলছে।’’ সোনুর ক্লাব বালিগঞ্জ স্পোর্টিংয়ের তরফে দেবাশিস সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘আমরা সোনুর পরিবারকে সাহায্য করব। পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছে।’’

অমরজিতের কাছে সোনুর ছবি চাওয়া হলে ফোনেই তিনি বলেন, ‘‘অনেক ছবি আছে। ওর ক্রিকেটের ডায়েরিও আছে। কিন্তু ও সব এক জায়গায় লুকিয়ে রাখা আছে। মা ওগুলো দেখলেই খুব কাঁদেন। সামলানো যায় না।’’

ফোনের কথোপকথন শেষ হওয়ার আগেই কাপড়ে হাত মুছে ঘরের দিকে ছুটলেন সোনুর মা। একটি ডায়েরি আর একটি বড় ছবি বার করে নিয়ে এসে বললেন, ‘‘এই আমার ছেলে। ক্রিকেটই ওর জীবন ছিল। এই ডায়েরিটায় ওর ক্রিকেটের সব কথা লেখা আছে।’’

উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের ডায়েরির পাতায় শুরুতেই রাহুল দ্রাবিড়ের ছবি। ছবির নীচে ইংরেজিতে লেখা, ‘দ্য ওয়াল। আমার আদর্শ’। এর পরে একে একে লেখা, কী করে খেলতে হয়— কভার ড্রাইভ, স্ট্রেট ড্রাইভ, পুল...!

চোখের জল আর মাথার ঘাম মুছতে মুছতে সোনুর মা বলতে থাকেন, ‘‘ধোনিরও ছবি আছে। উল্টে দেখুন..! ও ধোনির মতো হতে চাইত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Cricketer Sonu Yadav Heatstroke
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE