Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘কাল এলে কঙ্কালটাও দেখা যেত’

এত দিন চলতে ফিরতে বাড়িটা নিয়ে কারও তেমন কৌতূহল ছিল না। কিন্তু শুক্রবার সকাল থেকে ৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের বাড়িটা ছেড়ে নড়তেই চাইছিলেন পাড়ার বাসিন্দা ও আশপাশের অফিসের কর্মীরা! বিরাট গেটওয়ালা বাড়িটার ভিতরের জটলায় তখন কে নেই!

দে বাড়ির অন্দরমহল।

দে বাড়ির অন্দরমহল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০১:১৮
Share: Save:

এত দিন চলতে ফিরতে বাড়িটা নিয়ে কারও তেমন কৌতূহল ছিল না। কিন্তু শুক্রবার সকাল থেকে ৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের বাড়িটা ছেড়ে নড়তেই চাইছিলেন পাড়ার বাসিন্দা ও আশপাশের অফিসের কর্মীরা!

বিরাট গেটওয়ালা বাড়িটার ভিতরের জটলায় তখন কে নেই! গৃহস্থ বাড়ির পরিচারিকা থেকে ব্যাঙ্ক অফিসার, ছিলেন রোদহীন বিকেলে রোদচশমা পরা ‘ভিআইপি’ এক মহিলাও। ভিড়ের মধ্যে থেকেই ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন এক যুবক। ফোনের ও-পারে থাকা কাউকে বলছিলেন, ‘‘সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল আছে। ভাড়াটেও আছে। চট করে নেওয়া যাবে না।’’ যা শুনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো প্রৌঢ়ের মন্তব্য, ‘‘ছেলেটা প্রোমোটার নাকি!’’

হবে না-ই বা কেন! পুলিশ সূত্রের খবর, অভিজাত পাড়ার ওই গোটা বাড়িটার বাজারদর এখন ৪০ কোটি টাকারও বেশি।

বৃহস্পতিবার সকালে ৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের ওই বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একটি মানুষ ও দু’টি কুকুরের কঙ্কাল। পুলিশ জানিয়েছে, কঙ্কালটি ওই বাড়ির মেয়ে দেবযানী দে-র। তাঁর মৃত্যুর পরে দাহ না করে দেহটি ঘরেই রেখে দিয়েছিলেন দেবযানীর ভাই পার্থ। এই খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হতেই সকাল থেকে ভিড় জমতে শুরু করে ওই বাড়ির চত্বরে। বেশির ভাগই বাড়ির ছবি তুলেছেন, কেউ বা ভিডিও। বেলা ১২টা নাগাদ এক নামী সংস্থার কয়েক জন কর্মী এসেছিলেন। বাড়ির চত্বরে দাঁড়িয়ে রীতিমতো সেলফিও তুলেছেন! চটপট আপলোড হয়ে গিয়েছে হোয়্যাটসঅ্যাপ-ফেসবুকে।

দুপুর আড়াইটে নাগাদ পৌঁছন দুই মহিলা ও এক পুরুষ। কথায় কথায় জানালেন, পার্থদের বাড়ির ঠিক পিছনেই একটি চর্মজাত পণ্য রফতানিকারী সংস্থায় কাজ করেন তাঁরা। ওই দলেই থাকা শিল্পা দাস নামে এক মহিলার আক্ষেপ, ‘‘ইস! কাল পায়ে ব্যথার জন্য এলাম না। এলে হয়তো কঙ্কালটা দেখতে পেতাম।’’ সেই আক্ষেপ এ দিন বাড়ির পোর্টিকো, শ্বেত পাথরের টেবিল দেখেই মিটিয়েছেন।

বিকেলে বাড়ির চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন রোদচশমা পরা এক মহিলা। পাশে সাফারি স্যুট পরা নিরাপত্তারক্ষী। নাম জিজ্ঞাসা করলে মহিলার জবাব, ‘‘আমি এক জন কৌতূহলী মাত্র।’’ কথা বলার ফাঁকেই কাকে যেন এসএমএসে লিখছিলেন ‘বাইট দিলে? বাইরে মিডিয়া আছে।’ এই বাক্যটি ‘কৌতূহলী’ সাংবাদিকের চোখ এড়ায়নি। মেসেজ পাঠিয়েই নিরাপত্তারক্ষীকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘স্যার কখন বেরোবে?’’ তার পরেই
বেরিয়ে গিয়ে উঠলেন নীলবাতি লাগানো সাদা স্করপিও গাড়িতে। যার পিছনে লেখা ‘গভর্নমেন্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’। সামনে বিধানসভার কার পার্কিং স্টিকার।

শুধু কৌতূহলই নয়, জটলায় মুখে মুখে গল্পও ছড়িয়েছে। ভরদুপুরে তিন প্রৌঢ়ের পাশে দাঁড়িয়ে কানে এল, মৃতদেহ কী ভাবে কঙ্কাল করা হল, পার্থ-দেবযানীর ব্যবহার কেমন ছিল, কুকুরের সঙ্গে মানুষের আত্মার পার্থক্য কী— এ সব নিয়ে নানা উদ্ভট গল্প চলছে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, কঙ্কাল উদ্ধারের খবর পড়ে অফিসের ফাঁকে ঢুঁ মারতে এসেছেন। এমনই এক জন দেবাশিস কুণ্ডু। কঙ্কাল কাণ্ড নিয়ে যাঁর অভিমত, ‘‘এর পিছনে অলৌকিক ঘটনা আছে।’’

এসেছেন আশপাশের এলাকায় থাকা বাসিন্দারাও। কী ভাবে কী হয়ে গেল, তা নিয়েই মশগুল হয়েছেন আলোচনায়। সব্যসাচী কুণ্ডু নামে এক যুবক বলছিলেন, ‘‘পার্থদাকে ছোটবেলায় দেখতাম। এমনটা যে ও করবে, ভাবতেও পারিনি।’’ দে পরিবারের এমন মৃত্যুতে আক্ষেপও করেছেন কেউ কেউ। ওই বাড়ির গেট থেকে বেরোতে বেরোতে এক বৃদ্ধা সঙ্গীকে বললেন, ‘‘এ পাড়ায় বোধ হয় একটাও বাঙালি থাকবে না!’’

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। রবিনসন স্ট্রিটে ভিড়টা তখনও পুরোপুরি বাড়িছাড়া হয়নি। অনেকেই অফিসফেরত ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন। বাড়ির ঠিক বাইরেই চায়ের দোকানে ভিড় করেছেন এক দল তরুণ-তরুণী। কাছের একটি অফিসেই কাজ করেন।

সেই চায়ের আড্ডাতেও জেগে রইল পার্থ-দেবযানী উপাখ্যান!

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE