Advertisement
১০ জুন ২০২৪

চলে গিয়েও যাদবপুর ক্যাম্পাসেই রয়ে গেলেন মিলনদা

মিলনদার ক্যান্টিনে ভিড় জমে। হাসিমুখে ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক সকলের চাহিদা সামলান মিলনদা।

মিলনদাকে (ইনসেটে) শেষ শ্রদ্ধা। মঙ্গলবার, যাদবপুরে। —নিজস্ব চিত্র।

মিলনদাকে (ইনসেটে) শেষ শ্রদ্ধা। মঙ্গলবার, যাদবপুরে। —নিজস্ব চিত্র।

সুজিষ্ণু মাহাতো
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৮ ০০:২৬
Share: Save:

মেঘলা আকাশ। মাঝেমধ্যে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। এমন দিনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে যেন আলসেমিতে পেয়ে বসে। মিলনদার ক্যান্টিনে ভিড় জমে। হাসিমুখে ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক সকলের চাহিদা সামলান মিলনদা।

মঙ্গলবারও মেঘলা ছিল ক্যাম্পাস। ছিল ভিড়ও। কিন্তু কলরবের ক্যাম্পাসের সেই ভিড় যেন হারিয়েছে ভাষা। কারণ সেই ভিড় বিশ্বাস করতে পারছে না, শেষ বারের মতো ক্যাম্পাসে এসেছেন মিলনদা। এসেছেন ফুলে ঢাকা শববাহী গাড়িতে।

মিলন দে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যান্টিনের পরিচালক। তবে এই পরিচয় কিছুই না মিলনদার জন্য। প্রায় পাঁচ দশক কাটিয়ে মিলনদা হয়ে উঠেছিলেন ক্যাম্পাস-জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দীর্ঘদিন ভুগছিলেন ফুসফুসের ক্যানসারে। তার মধ্যেও ক্যাম্পাসে আসতেন নিয়মিত। অসুস্থতা বাড়ায় আসা কমে গিয়েছিল। মাস দেড়েক আগে ক্যান্টিনের সামনেই দেখা হয়েছিল মিলনদার সঙ্গে। বলেছিলেন, ‘‘যাদবপুরে না এলে দিনটা পূর্ণ হয় না। খালি থেকে যায়...’’।

সোমবার সন্ধ্যায় মিলনদার প্রয়াণের খবর ছড়াতেই ফেসবুকে আছড়ে পড়ে আবেগের স্রোত। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রাক্তনী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র সকলেই শেয়ার করেন ছবি, স্মৃতি। ‘কাল্ট’ হয়ে যাওয়া ঢপের চপ (পুর ভরা পাঁউরুটির চপ), গরম জলের (লাল চা) গল্প। সেই আবেগের রেশ রইল মঙ্গলবারও।

সোমবার সকাল থেকেই ভিড় জমেছিল ক্যান্টিনের সামনে। সওয়া ১১টা নাগাদ শববাহী গাড়ি প্রথমে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে। সেখানে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পরে আনা হয় ক্যান্টিনের সামনে। প্রাক্তনী, বর্তমান ছাত্র সকলেই কাঁধ দিয়ে নামিয়ে আনেন প্রিয় মিলনদাকে। বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপকেরা শ্রদ্ধা জানান, সান্ত্বনা দেন মিলনদার স্ত্রী কৃষ্ণাদেবীকে।

অবসরের পরে রোজ আসেন না। তবে এ দিন এসেছিলেন ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র থাকার সময় থেকেই মিলনদার সঙ্গে পরিচয়। মিলনদাকে কেবল একজন রন্ধন বিশেষজ্ঞ বা সফল জনসংযোগকারী হিসেবে দেখতে নারাজ তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘মিলনের সঙ্গে রাজনীতি, বদলে যাওয়া সময় নিয়ে যা কথা হত তাতেই বোঝা যেত ও একজন গোপন বিদ্বান। ওঁকে আমরা চিনতে পারিনি।’’

মিলনদার ক্যান্টিন আক্ষরিক অর্থেই নানা মতের মিলনের একটা পরিসর তৈরি করেছিল বলে মনে করেন তুলনামুলক সাহিত্য বিভাগের প্রাক্তনী কৌস্তভ চক্রবর্তী। তা ছিল একাধারে অ্যাকাডেমিক চর্চা, রাজনৈতিক তরজা, আড্ডা বা প্রেমের ঠিকানা। তাঁর কথায়, ‘‘মিলনদা ছিলেন সমদর্শী। তিনি উপাচার্য থেকে প্রথম বর্ষের কোনও ছাত্র— সমান গুরুত্ব দিয়ে সকলের কথা শুনতেন।’’

প্রাক্তনী দেবযান সেনগুপ্ত জানালেন, মিলনদার ফুটবল প্রেমের কথা। তাঁর কথায়, ‘‘এক দিন খেলার পরে খাওয়ার কুপন হারিয়ে গিয়েছিল। মিলনদাকে সে কথা বলতে হেসে উড়িয়ে দেন। সকলকে খেতে দিয়ে ফুটবল নিয়ে নানা গল্পও করেছিলেন।’’

সমাজবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সায়ন সিংহ ক্লাসের ফাঁকে এই ক্যান্টিনে বসেই দোতারা বাজান। তাঁর কথায়, ‘‘এর পরে যারা ভর্তি হবে, তারা জানতেও পারবে না মিলনদাকে না পেয়ে তারা কী পেল না!’’ পড়ুয়ারা জানান, আজ, বুধবার বিকেল ৪টেয় ক্যান্টিনেই মিলনদার স্মরণে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছে।

মিলনদা শুয়ে আছেন ক্যান্টিনের সামনে। অনেকের মোবাইল বাজছিল। সকলেই বলছেন, ‘‘মিলনদায় আয়। মিলনদা এখানেই আছে।’’ চলে গিয়েও রয়ে গিয়েছেন মিলনদা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE