Advertisement
E-Paper

বিচারের আশায় এসে নির্বিচার ভোগান্তি

ব্যারাকপুরের প্রশান্ত চোংদারের কিডনি বিকল। কিডনিদাতা পেয়েও তিনি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। কারণ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মতো অন্যের কিডনি নিতে গেলে যে হলফনামা জমা দিতে হয়, তা তিনি দিতে পারছেন না।

শমীক ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৯ ০২:৪৫
আশাহত: ব্যাঙ্কশাল আদালতে স্বামীর জামিন করাতে এসে ফিরে যেতে হল সোনি খাতুনকে। শুক্রবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

আশাহত: ব্যাঙ্কশাল আদালতে স্বামীর জামিন করাতে এসে ফিরে যেতে হল সোনি খাতুনকে। শুক্রবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

রাত পেরোলেই সপ্তম দফার লোকসভা নির্বাচন। কলকাতা ও তার লাগোয়া এলাকার কয়েক লক্ষ মানুষ তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে যাবেন। অথচ, রাজ্য জুড়ে আইনজীবীরা কাজ বন্ধ রাখায় এই শহরেরই কয়েক হাজার নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে মাসখানেক ধরে।

ব্যারাকপুরের প্রশান্ত চোংদারের কিডনি বিকল। কিডনিদাতা পেয়েও তিনি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। কারণ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মতো অন্যের কিডনি নিতে গেলে যে হলফনামা জমা দিতে হয়, তা তিনি দিতে পারছেন না। ব্যারাকপুর আদালতের আইনজীবীরা কাজ বন্ধ রাখায় তিনি ভেবেছিলেন, ব্যাঙ্কশাল আদালতে এসে নোটারি-কে দিয়ে হলফনামা তৈরি করিয়ে নেবেন। শুক্রবার সকালে অসুস্থ শরীর নিয়ে ব্যাঙ্কশাল আদালতে এসেওছিলেন বছর পঞ্চান্নের প্রশান্তবাবু। কিন্তু ওই আদালতের করণিক দীপায়ন কর তাঁকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন।

ওই করণিক বলেন, ‘‘শুধু প্রশান্তবাবু নন, গত সপ্তাহে এক কিডনি বিকল হওয়া মহিলাকে স্ট্রেচারে করে আনা হয়েছিল। এমন কোনও আইনজীবী মেলেনি, যিনি নোটারি বা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওই মহিলাকে চিহ্নিত করবেন।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নোটারি বলেন, ‘‘নোটারি যিনি হন, তাঁকেও আইনজীবী হতে হয়। তবেই নোটারির লাইসেন্স মেলে। বার কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাজ বন্ধ রাখা হবে ২১ মে পর্যন্ত। তা অমান্য করার ক্ষমতা আমাদের নেই।’’

কাজবিহীন বসে আলিপুর আদালত চত্বরের এক টাইপিস্ট। শুক্রবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

এ দিন সকালে আলিপুর জেলা দায়রা আদালতের প্রধান বিচারক (ডিস্ট্রিক্ট জজ) রবীন্দ্রনাথ সামন্তের এজলাসে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক তরুণী। এক যুবকের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন মাসখানেক আগে। পরে আদালতে হলফনামা দিয়ে জানান, সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে চান। কারণ, ওই যুবককেই বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি। এ দিন হবু শাশুড়ির সঙ্গে প্রধান বিচারকের এজলাসে দাঁড়িয়ে তরুণীর আর্জি, ওই যুবকের জামিন মঞ্জুর করা হোক। কিন্তু যুবকের আইনজীবী আদালতে হাজির থেকেও জামিনের আবেদন জানাতে পারলেন না। কারণ, বার কাউন্সিল কাজ বন্ধ রাখতে ‘অনুরোধ’ করেছে।

এ দিন দুপুর দেড়টায় ব্যাঙ্কশাল আদালতের দু’নম্বর গেটের সামনে সন্তান কোলে দাঁড়িয়ে ছিলেন এন্টালির মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা সোনি খাতুন। গেটের সামনে জেলের গাড়িতে বসে রয়েছেন তাঁর স্বামী মহম্মদ সিকন্দর। ছিনতাইয়ের অভিযোগে ৫ মে তাঁকে গ্রেফতার করেছিলেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। আইনজীবীদের কাজ বন্ধ থাকায় কেউ সিকন্দরের হয়ে জামিনের আবেদন করছেন না। সোনি বলেন, ‘‘এ নিয়ে তিন দফায় স্বামীর জামিন করাতে এলাম। কেউ দাঁড়াচ্ছেন না।’’

ব্যাঙ্কশাল আদালতের টাইপিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতা অসীম চক্রবর্তী জানান, আইনজীবীরা কাজ বন্ধ রাখায় তাঁদের ৮০ শতাংশ রোজগার কমে গিয়েছে। নোটারির কাজ বন্ধ থাকায় ফিরে যেতে হচ্ছে বিদেশে পড়তে চাওয়া পড়ুয়াদের। ‘মিউটেশন’, ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’, সম্পত্তি হস্তান্তর, দানপত্র-সহ কোনও দেওয়ানি কাজই হচ্ছে না। তার ফলে শুধু বিচারপ্রার্থীরাই নন, মামলার সঙ্গে সম্পর্কহীন মানুষও হয়রান হচ্ছেন।

এ দিন দুপুরে সিটি সিভিল কোর্ট থেকে শুকনো মুখে ফিরে গিয়েছেন বেহালার বাসিন্দা গোবিন্দলাল সরকার। পুকুর বুজিয়ে এলাকায় বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করতে তথ্য জানার অধিকার আইনের সাহায্য নিতে এসেছিলেন। কোনও আইনজীবী সাহায্য করেননি।

ফরাক্কার বাসিন্দা, উচ্চ প্রাথমিক টেট-উত্তীর্ণ দুই প্রার্থী এ দিন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করতে এসে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যান। মহম্মদ পলাশ ও ওবাইদুর রহমান নামে ওই দু’জন জানান, তাঁদের থেকে কম নম্বর পাওয়া প্রার্থীদের নাম মেধা তালিকায় উঠেছে। তাঁদের নাম ওই তালিকায় কেন নেই, সেই প্রশ্ন তুলে ও প্রতিকার চেয়ে তাঁরা মামলা করতে চান। তাঁদের আইনজীবী জানিয়ে দিয়েছেন, ২১ মে-র বৈঠকে বার কাউন্সিল কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখে তাঁরা যেন যোগাযোগ করেন।

আইনজীবীরা কাজ বন্ধ রাখায় বিচারপ্রার্থী, করণিক, টাইপিস্টরা যেমন বিপদে পড়েছেন, তেমনই দুর্ভোগে পড়েছেন আদালত চত্বরের ছোট হোটেল বা খাবারের দোকানের মালিকেরাও। ব্যাঙ্কশাল আদালত চত্বরে ১৯১০ সাল থেকে একটি হোটেল চালায় তারকেশ্বরের চৌধুরী পরিবার। হোটেলের অন্যতম মালিক, আদতে তারকেশ্বরের বাসিন্দা নুরুল চৌধুরী এ দিন জানান, ২৫ এপ্রিল থেকে কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই দিনই হোটেলের কর্মীদের তিনি বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। চেয়ার, টেবিল তুলে দরজা বন্ধ করে বসে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘খদ্দের নেই। হাতে গোনা কয়েক জন বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেটের চেম্বারে খাবার পৌঁছে দিয়ে ক’টা টাকাই বা মেলে!’’

Strike Court Lawyer Law and Order
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy