বন্ধু শ্রীধর মহারানার সঙ্গে চার বছর বাদে দেখা হচ্ছে ইভজিনিয়া নেস্তেরোভার। সে-বার তাইল্যান্ডের মন্দিরে যাঁর হাতের একটানে এঁকে ফেলা ‘পাতাচিত্রা’ (পটচিত্র) দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন রুশ তরুণী।
দীক্ষিত বৈষ্ণব ইভজিনিয়াকে ওড়িশার পটশিল্পী শ্রীধর ডাকেন ‘গোবিন্দময়ী’ বলে। গোবিন্দময়ী ভদকা খান না। মাছ-মাংস ত্যাগ করেছেন। গলায় তুলসীমালা পরে দেশে-দেশে ঘুরে বিষ্ণু, শিব, জগন্নাথ বা ব্রহ্মার ছবি আঁকছেন। কলকাতায় লোকশিল্পীদের একটি জমায়েত এ বার তাঁদের মিলিয়ে দিচ্ছে।
তবে দুই শিল্পীর আসল মিল অন্য। দু’জনেই প্রাকৃতিক রঙের উপাদানে ছবিকে জীবন্ত করে তোলেন। বাংলা-ওড়িশার পটশিল্পীদের মতো গোবিন্দময়ীর চিত্রকলার ঘরানাও পরম্পরাগত। তাঁর মা-ও শিল্পী। নানা কিসিমের ফুল-পাতা-ফলের (বেরি) রং ব্যবহার করে ফুটিয়ে তোলা ছবির আঙ্গিকটির নাম খখলোমা।
বীরভূম, মেদিনীপুর, ঝাড়খণ্ডের সিংভূম বা ওড়িশার রঘুরাজপুরে চিত্রকর ঘরে ছবি আঁকতে বসে এখনও বৃদ্ধ দাদু হয়তো নাতিকে হাঁক দেন, ‘উঠোন থেকে শিমগাছের পাতা ছিঁড়ে আন তো।’ সেই পাতা বা নানা ধরনের পাথর, কাঁকর, গেঁড়ি-গুগলির খোল ভেঙে বা শিলনোড়ায় বেটে আশ্চর্য সব রং তৈরি করতে তুখোড় অখ্যাত শিল্পীরা, যা ছবিতে অনন্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে।
কলকাতায় সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের ‘কারিগর হাট’-এ এই প্রাকৃতিক উপাদানের শিল্প ঘরানাকে মেলে ধরতেই এ বার এগিয়ে এসেছে নাবার্ড। পরিবেশবন্ধু শিল্প ও শিল্পীর প্রসারে ব্রতী একটি সংস্থা এইম (আর্ট ইলিউমিনেট্স ম্যানকাইন্ড) আয়োজিত মেলার পাশে দাঁড়িয়েছে তারা। নাবার্ড-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার চিফ জেনারেল ম্যানেজার রাজি গায়েনের মতে, “এ দেশে গ্রামীণ জীবনের মান উন্নত রাখতে গ্রামীণ শিল্প ঘরানাকে বাদ দেওয়ার উপায় নেই।”
পটশিল্পীদের সঙ্গে মথুরার সাঁঝি বা বিহারের মধুবনীর শিল্পীরাও কারিগরমেলা-য় জড়ো হচ্ছেন। কলকাতার মঞ্চে গ্রামের কারিগরদের নিজেদের কাজ যুগোপযোগী করতে নানা ধরনের তালিম দেওয়া হবে। শেখানো হবে বিপণনের কৌশল। প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে বিভোর দেশ-বিদেশের শিল্পীদের শহুরে ক্রেতা বা রসিকজনের সঙ্গে মেলানোর একটা পরিসরও গড়ে উঠবে।
মথুরার মোহনকুমার বর্মা, মধুবনী জেলার ঘিওয়ায়ি গ্রামের ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ শান্তিদেবী বা পিংলার নয়া গ্রামের বাহাদুর চিত্রকরও মুখিয়ে আছেন কলকাতায় আসতে। মোহনকুমার খড়, তুষ বা কৃষিজাত পণ্যে তৈরি কাগজ কেটে কৃষ্ণলীলার নানা দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন। শান্তিদেবী চালের গুঁড়ির আলপনার কসরতে চৌকস। বাহাদুর চিত্রকর পুঁইমিটুলি, কাঁচা হলুদ বা রংবেরঙের পাথরকে পোষ মানিয়ে আশ্চর্য রং ছেঁকে নিয়ে পট আঁকেন।
প্রাকৃতিক রঙের মহিমায় মুগ্ধ প্রবীণ চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীর মতে, এই লোকশিল্পীরাই কিন্তু ভারতের অজিন্ঠা, ইলোরার শিল্প ঘরানার উত্তরাধিকারী। প্রাচীন ভারতের গুহাচিত্রে পাথুরে রঙের সৃষ্টি হাজার হাজার বছরের ক্ষয় সহ্য করে বেঁচে রয়েছে। সিমা আর্ট গ্যালারির সঙ্গে যুক্ত শিল্পী কিংশুক সরকার জাপান থেকে প্রাকৃতিক রং দিয়ে কাজের তালিম নিয়ে এসেছেন। তাঁর আফসোস, জাপানে বা অন্যত্র এই পরিবেশবন্ধু শিল্পভাবনাই বহু ক্ষেত্রে মূল স্রোতে মিশে গিয়েছে। ৫০ ফুটের বেশি দীর্ঘ ‘ইনস্টলেশন’ও প্রাকৃতিক রঙেই হচ্ছে। তাঁর কথায়, “এখনও ভারতকে প্রাচীন চিত্রকলা, স্থাপত্যের জন্যই দুনিয়া মনে রেখেছে। এখানেও দেশজ প্রাকৃতিক ঘরানার চর্চা আরও বাড়ানো উচিত।”
রাসায়নিকজাত রঙের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়েও শিল্পীদের দ্বিমত নেই। কারিগরমেলা-র উদ্যোক্তারা বলছিলেন, শিল্পের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতার বার্তা দিতে হলে নিজেদেরও প্রাকৃতিক পরিবেশবন্ধু উপাদানের কাজকেই মেলে ধরা উচিত। এমন শিল্পচর্চায় শুধু কারিগরদের নয়, আখেরে সব মানুষেরই ভাল হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy