কবিবন্ধু প্রবোধচন্দ্র মহলানবিশকে নিয়ে চণ্ডীচরণ সাহা শান্তিনিকেতনে হাজির, তাঁর নতুন সংস্থা ‘হিন্দুস্থান মিউজ়িক্যাল প্রোডাক্টস ভ্যারাইটি সিন্ডিকেট’-এর জন্য কবিকণ্ঠ রেকর্ডের আর্জি নিয়ে। সেই অনুরোধ রাখতে ১৯৩২ সালের ৫ এপ্রিল ৬/১ অক্রূর দত্ত লেনের স্টুডিয়োতে এসে ‘তবু মনে রেখো’ গান আর ‘আমি যখন বাবার মতো হব’ রেকর্ড করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ— জর্জ নিউমান ডিস্ক রেকর্ডিং মেশিনে (ছবিতে)।
পঁচিশে বৈশাখ সমাগত, রবীন্দ্রগানে মুখরিত শহর। এই আবহে ফিরে দেখা যেতে পারে কলকাতার সেই সব জায়গা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ রেকর্ড করতে এসেছিলেন। গ্রামোফোন কোম্পানির স্টুডিয়োর কথা বলতেই হয়, ১৯২৬ সালে কবিকণ্ঠের রেকর্ডিং করেই তাদের বেলেঘাটার কারখানায় বৈদ্যুতিক রেকর্ডিং ব্যবস্থার শুরু। সে বছরেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, তাঁর সহোদর প্রফুল্লচন্দ্র ও গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডিং প্রতিনিধি ভগবতীচরণ ভট্টাচার্য আবার উদ্যোগ করেন কবিকণ্ঠ রেকর্ডের। আপার চিৎপুর রোডের এক বাড়িতে কয়েক বার রিহার্সাল করতে এসেছিলেন কবি। রেকর্ডিং হয় বেলেঘাটায়। তবে শেষ পর্যন্ত সবগুলি রেকর্ড প্রকাশের অনুমতি দেননি তিনি।
তবে পরীক্ষামূলক উদ্দেশ্যে কবিকণ্ঠ রেকর্ড করা হয় অনেক আগেই। ১৮৯১-৯২ সাল নাগাদ প্রেসিডেন্সি কলেজে একটি ফোনোগ্রাফ যন্ত্র এসেছিল। জগদীশচন্দ্র বসু সেই যন্ত্রে ব্রাহ্ম সমাজের কয়েক জন পুরুষ ও মহিলার কণ্ঠে কিছু গান রেকর্ড করেন। রবীন্দ্রনাথের গাওয়া ব্রহ্মসঙ্গীতও রেকর্ড করা হয়েছিল সে সময়।
তবে কবিকণ্ঠ রেকর্ড করে প্রচার করার প্রথম প্রয়াস বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোগী হেমেন্দ্রমোহন বসুর হাত ধরে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান ও কবিতার রেকর্ডিং করেন তিনি। ১৯০৮ সালে ফ্রান্সের প্যাথে রেকর্ডিং কোম্পানির সাহায্য ‘প্যাথে-এইচ বোস ডিস্ক রেকর্ড’-এ রবীন্দ্রকণ্ঠের গান ও আবৃত্তি নতুন করে রেকর্ডিং করা হয়। এই রেকর্ড করার জন্য রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েক বার এসেছিলেন উত্তর কলকাতার শিবনারায়ণ দাস লেনে হেমেন্দ্রমোহনের বাড়িতে। সেই নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্দীপনার কথা জানা যায় অমল হোমের স্মৃতিকথায়— গলির দু’পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন মানুষজন। রেকর্ড নিখুঁত করার জন্য কোনও গান দু’বার গাইতে হলে তাঁদের আনন্দের সীমা থাকত না।
এই রেকর্ডের মধ্যে কবিকণ্ঠে গীত ‘বন্দে মাতরম্’ গানের একটি রেকর্ড ১৯৬২ সালে উদ্ধার করেন গবেষক ও গ্রামোফোন কোম্পানির প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা সন্তোষকুমার দে। কলকাতায় রবীন্দ্র সদন উদ্বোধনের সময় বাজানো হয়েছিল সেই গান। ১৯৬৬ সালের, ১৩৭৩ বঙ্গাব্দের সেই দিনটিও ছিল পঁচিশে বৈশাখ!
কাছে রাখার
রোজকার জীবনে বিপুলায়তন রবীন্দ্ররচনার অনেক অংশ স্মরণ করতে ইচ্ছে করে, কখনও দরকার পড়ে নির্ভুল ভাবে তা উদ্ধৃত করার। কার্যক্ষেত্রে অনেক সময় মনে পড়ে না তা, কিংবা কোন বই কোন রচনায় তার উৎস, তা নিয়ে জাগে সংশয়। এই সঙ্কটে অনেকটা স্বস্তি দেবে রবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়: রবীন্দ্র-রচনার উদ্ধৃতি সংকলন (প্রকাশক: লালমাটি) বইটি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গল্প ও উপন্যাস, নাটক, ‘ডায়ারি’ ও চিঠিপত্র এবং প্রবন্ধ— পাঁচটি ভাগে উদ্ধৃতিগুলি বিন্যস্ত করেছেন সঙ্কলক-সম্পাদক অমল পাল, মোট সংখ্যা ৩৪০৫! অভিধানের মতো বর্ণানুক্রমে সাজানো উদ্ধৃতিগুলি, শেষাংশে আছে ‘বিষয়-নির্দেশিকা’ও, পাঠকের সুবিধায়। প্রতিটি উদ্ধৃতির সঙ্গে দেওয়া আছে উৎস। প্রায় ন’শো পৃষ্ঠার বৃহদ্বপু বই, আম পাঠক থেকে গবেষক, সকলেরই কাজে লাগবে। ছবিতে রবীন্দ্র-হস্তাক্ষরে বঙ্কিমচন্দ্র কবিতাংশ।
পুনর্মিলন
শতবর্ষের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলা... এ বছর জানুয়ারি মাসে ৯৫তম বর্ষে পদার্পণ করেছে বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলের প্রাক্তনীদের পুনর্মিলন উৎসব বাঁধাধরা, করোনা পরিস্থিতিতে আগের বছর তা করা যায়নি। এ বছর আবারও স্বমহিমায় ফিরেছে এই পুনর্মিলন উৎসব। সাম্প্রতিক এই আয়োজনের আকর্ষণ ছিল প্রাক্তনীদের গান, আর অবশ্যই শতবর্ষে সত্যজিৎ-স্মরণ, বিশ্ববরেণ্য পরিচালক যে এই স্কুলেরই প্রাক্তনী! ছিলেন রাঘব চট্টোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা রায় প্রমুখ, এ ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রেরা, সপরিবার। কোভিড-সতর্কতা মাথায় রেখে অল্প সময়ের মধ্যেই এই আয়োজন, সহ-সাধারণ সম্পাদক যুধাজিৎ মুখোপাধ্যায় জানালেন।
অমূল্য উদ্ধার
‘এস মুক্ত করো অন্ধকারের এ দ্বার’, ‘সুনো হিন্দকে রহনেওয়ালোঁ’, ‘ফিরাইয়া দে দে’, ‘আরে ও কাশ্মীর, মোদের ছাইড়া কই চইলা গেলা’... আইপিটিএ-র ‘ঐতিহাসিক’ সব গান। ১৯৭৫-এর ১৭ অগস্ট মুক্ত অঙ্গনে এক অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন শিল্পীরা— জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বিজন ভট্টাচার্য, রেবা রায়চৌধুরী-সহ অনেকে। উপলক্ষ ছিল বিনয় রায়ের স্মরণ, চল্লিশের দশকে আইপিটিএ-র বিশিষ্ট কর্মী সদস্য, গায়ক তিনি— ছিলেন ১৯৬৯-এ সদ্যপ্রতিষ্ঠিত জেএনইউ-এর রুশ কেন্দ্রের প্রধানও। সে দিন মঞ্চে শিল্পীদের পিছনে বসে সেকেলে স্পুল রেকর্ডারে অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করেছিলেন অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সম্প্রতি মৈনাক বিশ্বাসের আগ্রহে ও বহু সুহৃদের উদ্যোগে ডিজিটাইজ় করা হল সেই অমূল্য অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং। যোগ হয়েছে গানের দৃশ্যমান বাণী, অপূর্ব সব ছবি, ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে আ পারফরম্যান্স অব আইপিটিএ সংস বাই আইপিটিএ আর্টিস্টস শিরোনামে।
মূল্য ও বোধ
কিছু পছন্দ হলে আমরা তা চাই। চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে ব্যবধান বেশি হলে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হয়ে ওঠে মূল্যবান। ব্যক্তিজীবনে কিছু যোগ্যতার নিরিখে আমাদের বোধে মূল্যবান হয়ে দেখা দেয় কিছু বৃত্তিও। তার সুফল পৌঁছয় পরিবেশে। তখন ‘থাকা’টা ভাল হয়, ‘রাখা’টাও। প্রাচীনের পরামর্শ তাই: বাইরে নয়, খোঁজো নিজ অন্তঃপুরে। অদ্বৈত বেদান্ত তিন রকম ‘থাকা’র খবর দিয়েছে— জাগতিক, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক। জাগতিক স্তরে ব্যবহারিক ভিত্তিতে মূল্যবোধ নির্ধারিত ও আচরিত হয়, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক স্তরেও বিশেষ কিছু মাত্রা নির্দিষ্ট বেদান্তে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মূল্য ও বোধ বিষয়ে গত ২৮ এপ্রিল এক আলোচনা হয়ে গেল সংস্কৃত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অদ্বৈত বেদান্ত বিভাগের আয়োজনে, ছিলেন অনুরাধা মুখোপাধ্যায় লোকনাথ চক্রবর্তী শিপ্রা চক্রবর্তী শ্রীজীব বর্ধন কাকলি ঘোষ রাজেশ্বর দ্বিবেদী-সহ বিশিষ্টজন।
সৃষ্টিসুখে
পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতার নিগড়ে বাঁধা পথে নয়, শিশুর পূর্ণ বিকাশ পেনসিল-ক্রেয়ন-রঙে, নাচ-গানে, বই পড়ায়। এই বিশ্বাস থেকেই, আদর্শবাদী শিক্ষকদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার পাঠভবন। পথ দেখিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় সুশোভন সরকার অমিয় বসু তরুণকুমার বসু প্রমুখ। শিল্প-সঙ্গীত-সাহিত্য-বিজ্ঞানের মুক্ত পরিবেশে বছরভর হয় নানা আয়োজন, তারই অঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের আঁকা ছবি ও শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা নিজের মনেই ছবি আঁকে; তৈরি করে লিনোকাট, স্লেটকাট, বাঁধনি, তার ও কাঠে গড়ে তোলে হরেক শিল্পকৃতি। দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে ছেদ ফেলেছিল অতিমারি, ফিরে এসেছে এ বছর— বিড়লা অ্যাকাডেমিতে, আগামী ১২ থেকে ১৫ মে, ৩টে থেকে ৭টা।
শিল্পভাষ
দেওয়াল, কাগজ, কাঠ, মাটি, ক্যানভাস, আলোকচিত্র— যে কোনও নির্মাণ পদ্ধতিতেই ধরা থাকে নির্মাণ প্রকৌশল আর শিল্পীর নান্দনিক বোধ। গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে চলছে স্বপন নায়েকের আলোকচিত্র প্রদর্শনী মিউজ়িয়ম অব ইনোসেন্স, উনিশ শতকের ‘গাম বাইক্রোমেট ছাপাই’ পদ্ধতির সফল প্রয়োগ সেখানে। স্রেফ ছবি ‘ছাপা’ নয়, ‘নির্মাণ’— বীরভূমের প্রকৃতিপটে নানা দৃশ্যে গড়া চিত্রভাষ (নীচে ছবিতে ডান দিকে)। বিকল্প প্রকরণের এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী সম্ভবত এই প্রথম। রবিবার ও ছুটির দিন বাদে ১৬ মে পর্যন্ত, ১১টা-সন্ধ্যা ৭টা। অন্য দিকে, সংস্কৃতিজগতের বিশিষ্টজন— রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ রায় (ছবিতে বাঁ দিকে) গণেশ পাইন বাবা আলাউদ্দিন সুচিত্রা সেন প্রমুখ ধরা পড়েছেন শিল্পী প্রসেনজিৎ সেনগুপ্তের রেখায়। কোভিডকালে আঁকা শতাধিক প্রতিকৃতিচিত্র থেকে শিল্পী যোগেন চৌধুরীর বেছে দেওয়া ত্রিশটি চিত্রকৃতি নিয়ে প্রসেনজিতের প্রদর্শনী ‘মাস্টারস্ট্রোক’ শুরু হচ্ছে আজ সন্ধ্যায়, মায়া আর্ট স্পেস গ্যালারিতে। দেখা যাবে ১৫ মে পর্যন্ত, দুপুর দুটো থেকে রাত ৮টা।
সুদৃশ্য
প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে দে’জ় মেডিক্যাল, বাংলা ও বাঙালির বিচিত্র ও বহুমাত্রিক জীবনযাত্রা সংস্কৃতিকে তুলে ধরে তার পাতায় পাতায়। সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে এ বছর তাদের নতুন ক্যালেন্ডারটি ভরে উঠেছে শিল্পী-পরিচালকের চলচ্চিত্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধায়। ছ’টি চলচ্চিত্র, পথের পাঁচালী (উপরে ছবিতে), জলসাঘর, গুপী গাইন বাঘা বাইন, জয় বাবা ফেলুনাথ, অরণ্যের দিনরাত্রি ও ঘরে বাইরে-র ছ’টি ‘আইকনিক’ দৃশ্য রঙে-রেখায় এঁকেছেন শুভময় মিত্র, সেগুলি দিয়েই সেজে উঠেছে দিনপঞ্জির পাতা। এর মধ্যেই অবশ্য রসজ্ঞজনের হাতে হাতে তথা হোয়াটসঅ্যাপে ফিরছে বহুবর্ণ ও সুদৃশ্য এই বাংলা ক্যালেন্ডার, অনেকেই ভাগ করে নিচ্ছেন নতুন বছরের শুভেচ্ছাবার্তার সঙ্গে এই ক্যালেন্ডারের ডিজিটাল প্রতিরূপটি একে অপরকে পাঠিয়েও।
সময়ের ছবি
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হয়েছে তো কী, ভাল ছবি দেখার জন্য এ শহর সদা উৎসুক। সেই সুযোগই করে দিচ্ছে ‘ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস’— ভারতের ইজ়রায়েল দূতাবাস এবং সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এসআরএফটিআই)-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে ইজ়রায়েলি চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে। ৯ থেকে ১৩ মে পাঁচ সন্ধ্যায় পাঁচটি ছবি— জ়িরো মোিটভেশন, সেভিং নেতা, বেথলেহেম, দ্য ম্যাচমেকার, দ্য ব্যালাড অব দি উইপিং স্প্রিং— এসআরএফটিআই-এর মূল প্রেক্ষাগৃহে। উদ্বোধন ৯ মে বিকাল ৫টায়, বাকি ক’দিন রোজ সন্ধে ৬টায় এই সময়ের ইজ়রায়েলকে বড় পর্দায় দেখার, চেনার সুযোগ পাবে শহর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy