Advertisement
০৫ মে ২০২৪

হাসপাতাল থেকে হোটেল, ওঁদের হাতেই স্টিয়ারিং

বাইপাসের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ‘ভ্যালে সার্ভিস’-এর কর্মী জ্যোৎস্না সর্দার (২৭)। প্রায় দু’বছর হয়ে গেল কাজে। থাকেন দমদমে। প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে ধরা পড়ে, ঠিকমতো হর্ন শুনতে পাচ্ছেন না। অনেক স্বপ্ন নিয়ে গাড়ি চালাতে আসা। কানে সমস্যা বোঝেননি?

এস্তোনারা বিবি

এস্তোনারা বিবি

অন্বেষা দত্ত
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৮ ০২:৫৭
Share: Save:

শীতের রাতে পুকুরে এক হাতে চুলের মুঠি ধরে মাথাটা ডুবিয়ে দিয়েছিল স্বামী। অন্য হাতে টিপে ধরেছিল গলা। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসার সেই রাতটা এস্তোনারা বিবির চোখ খুলে দিয়েছিল। ‘বরের ঘর’ ছেড়ে বেরিয়ে যান। ছেলে-মেয়েকে রাখেন মায়ের কাছে। একাদশ শ্রেণির পরে পড়ার সুযোগ হয়নি। এক দিন একটা লিফলেটে চোখ পড়ে— মেয়েদের গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে।

খোঁজ নিয়েও পিছিয়ে যান। মনে হয়েছিল, মেয়ে হয়ে গাড়ি চালাব! মগরাহাটের প্রতিবেশীরা কী বলবে! এখন সাতাশের তরুণী, সেই এস্তোনারা শহরের পাঁচতারা হোটেলের ‘ভ্যালে সার্ভিস’-এ (হোটেলের অতিথিদের ধরনের গাড়ি সযত্নে পার্কিং এবং অতিথি বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে ঠিক মতো সে গাড়ি তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার পরিষেবা) দম ফেলার ফুরসত পান না।

দেশি গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ছ’-সাত মাসের প্রশিক্ষণ গড়িয়ে যায় এক-দেড় বছরে। ‘সৌজন্যে’ স্বামীর নিগ্রহ। যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এস্তোনারার পাশে থেকে তাঁকে এই দিনটা দেখতে সাহায্য করেছে, তাদের কাছে জানা গেল, ওঁর স্বামী সেখানেও গিয়েও উৎপাত করেছে। কিন্তু এস্তোনারার জেদের কাছে সব হার মেনেছে।

সাধারণ গাড়ি চালানোর বিদ্যে নিয়ে পাঁচতারা হোটেলে দামি বিদেশি গাড়ির চালকের আসনে বসে ভয় করেনি? হলই বা অল্প সময়! ডাকাবুকো মেয়ে বলেন, ‘‘এক বার একটা বিএমডব্লিউ-এর পিছনে ধাক্কা লেগে গেল। এত বড় গাড়ি! আন্দাজ পাইনি। হোটেলের দাদারা সামলে দিয়েছে।’’ চাকরির তিন-চার মাস পরে এখন চোস্ত এস্তোনারা। ছেলে-মেয়ের যত্ন নিচ্ছেন। ভাবছেন, নিজের এক টুকরো আস্তানা তৈরি করবেন। সন্তানরা যেন বলতে পারে, ‘আমাদের মায়ের বাড়ি।’

জ্যোৎস্না সর্দার

ছিপছিপে তরুণীর গলায় সামান্য হতাশাও, ‘‘ঘরে দরজা দিয়ে বর তো নিজের মেয়েকেও মারত। কী করে থাকতাম?’’ স্বামীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তবু ভালবাসা যায়নি। ‘‘ওকে দেখলে মাথা জ্বলে যায়। কিন্তু একেবারে ছেড়ে দেব, ভাবতে পারি না।’’ ফিরে যাবেন? ‘‘যদি থাকতে পারি, যাব। গাড়ি চালানো ছাড়ব না। এটাই এখন সারা জীবনের সঙ্গী।’’

বাইপাসের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ‘ভ্যালে সার্ভিস’-এর কর্মী জ্যোৎস্না সর্দার (২৭)। প্রায় দু’বছর হয়ে গেল কাজে। থাকেন দমদমে। প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে ধরা পড়ে, ঠিকমতো হর্ন শুনতে পাচ্ছেন না। অনেক স্বপ্ন নিয়ে গাড়ি চালাতে আসা। কানে সমস্যা বোঝেননি?

‘‘শুনতে একটু অসুবিধে হত। এক কানের পর্দা ফেটে গিয়েছে, বুঝিনি!’’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উদ্যোগী হয়ে অস্ত্রোপচার করিয়েছে। সে টাকা বেতন থেকেই শোধ করবেন জ্যোৎস্না। মুখচোরা লাজুক মেয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসলেই আত্মবিশ্বাসী। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মায়ের দায়িত্ব সামলে কাজে আসা। কাজের সুবাদে নানা ধরনের গাড়িতে বসার সুযোগ হয়। অল্পক্ষণ বসেই শিখে নেন যা শেখার। উৎসাহ এমনই। ‘‘পার্কিং একটা বড় ব্যাপার। সার সার দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির মধ্যে ঠিক করে পার্কিং করা মুখের কথা নয়,’’ বলেন জ্যোৎস্না। কাজের জায়গাই তাঁর সব। সে কথা বললেই ঝিকিয়ে ওঠে চোখমুখ। এর পরে কী? ‘‘বিয়ে করলে মাকে কে দেখবে? যদি কোনও দিন পরিস্থিতি পাল্টায়, অন্য কোথাও গেলেও এই কাজই করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Woman মহিলা
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE