Advertisement
০৭ অক্টোবর ২০২৪

মহিলা, তাই লাইসেন্স পেয়েও অটো চালানোর ‘অধিকার’ পাননি ওঁরা

স্বামী বাড়ি ফিরতেই রোজ রাতে তাঁর অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন কৃষ্ণা বিজলি। টালিগঞ্জ, রাসবিহারী, হাজরার রাস্তায় হাতে ধরে তাঁকে অটো চালাতে শিখিয়েছেন স্বামী রবীন।

লাইসেন্স পেয়েছেন রূপা নায়েক। কিন্তু পাননি অটো নিয়ে পথে নামার ‘অধিকার’। কারণ একটাই, তিনি মহিলা। বুধবার, টালিগঞ্জে।  ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

লাইসেন্স পেয়েছেন রূপা নায়েক। কিন্তু পাননি অটো নিয়ে পথে নামার ‘অধিকার’। কারণ একটাই, তিনি মহিলা। বুধবার, টালিগঞ্জে।  ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৮ ০১:৫৬
Share: Save:

ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল আগেই। প্রশিক্ষণ নিয়ে তৈরি ছিলেন মেয়েরাও। কিন্তু দিল্লি, মুম্বই, সুরাত, বেঙ্গালুরু বা রাঁচীর মতো শহর অনায়াসেই যা পেরেছে, বহু চেষ্টা করেও তা পেরে উঠল না কলকাতা! অটো নিয়ে পথে নামার স্বপ্ন পূরণ হল না এ শহরের মেয়েদের। কারণ, এক শ্রেণির পুরুষ অটোচালক তা চান না। সেই ‘না চাওয়া’-কে অবশ্য পূর্ণ সমর্থন করছেন খোদ অটো ইউনিয়নের নেতাই। তাঁর যুক্তি, অটো চালাতে গেলেই নাকি মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হতে পারেন!

যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এক জন মহিলা, যেখানে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের তরফে নানা বড়াই করা হয় বারবার, সেখানে এমন ঘটনা কী ভাবে মেনে নিচ্ছেন উপরের স্তরের নেতারা? দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা আইএনটিটিইউসি-র সভাপতি এবং সদ্য রাজ্যসভায় নির্বাচিত শুভাশিস চক্রবর্তী বললেন, ‘‘এই ধরনের অশ্লীল কথা আমাদেরও কানে এসেছে। ওখানকার অটোচালকদের ধারণা হয়েছে, মহিলারা অটো নিয়ে নামলে ওদের কাজ থাকবে না। কিছুতেই বোঝাতে পারছি না।’’

স্বামী বাড়ি ফিরতেই রোজ রাতে তাঁর অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন কৃষ্ণা বিজলি। টালিগঞ্জ, রাসবিহারী, হাজরার রাস্তায় হাতে ধরে তাঁকে অটো চালাতে শিখিয়েছেন স্বামী রবীন। লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করা রূপা নায়েকও শিখে নিয়েছিলেন অটো চালানো। তাঁর মনে হয়েছিল, রান্নার কাজে নিরাপত্তা নেই। তার থেকে অটো চালানোই ভাল। টালিগঞ্জ ফাঁড়ি এলাকার বাসিন্দা তন্দ্রা সাধুখাঁ পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পড়াশোনা চালাতে পারেননি। এখন বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ বিলি করেন। ২৭ বছরের ওই তরুণীর মনে হয়েছিল, খবরের কাগজ বিলি করে চালানো কঠিন। পাড়ার কাকুদের ধরে তাই অটো চালাতে শিখে নেন তিনিও।

শুধু এঁরাই নন, অটো চালিয়ে স্বপ্নপূরণের এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন শ্রাবণী সুতার, শম্পা কুণ্ডুদের মতো অনেকেই। কিন্তু তাঁদের সেই সাধ পূর্ণ হয়নি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি টালিগঞ্জ-হাজরা রুটে মহিলারা গোলাপি অটো চালাবেন বলে ঘোষণা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি পুরুষ অটোচালকদের আপত্তিতে। ওই রুটে তৃণমূল পরিচালিত অটো ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তারক দে বলেন, ‘‘মেয়েরা অটো চালাবে? তা আবার হয় নাকি? লাইনের এতগুলো ছেলে কখনওই তা মেনে নেবে না। তা ছাড়া, লাইনটা তো ভাল নয়। কেউ রেপ করে দিলে, তার দায় কে নেবে?’’ সেই সঙ্গেই তাঁর সংযোজন, ‘‘মহিলারা বাড়িতেই ভাল। অটো চালানো তাঁদের কাজ নয়। ছেলেরা কী করে ফেলবে, বলা তো যায় না!’’

তবে কি আপনার আপত্তিতেই পথে নামতে পারছেন না মহিলা অটোচালকেরা? তারকবাবুর উত্তর, ‘‘কিছু লোক আমাদের না জানিয়ে নিজেরা নাম করার জন্য ওটা করছিল। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। পরে বুঝে বন্ধ করে দিয়েছি।’’

ঠিক উল্টো ছবি রাঁচীতে। শহর জুড়ে দাপটে গোলাপি অটো চালাচ্ছেন মহিলারাই। —নিজস্ব চিত্র।

চালাতে শিখেও অটো নিয়ে পথে নামতে না-পেরে ক্ষুব্ধ রূপা নায়েক বলেন, ‘‘আমাদের যাতে কেউ অটো ভাড়া না দেয়, সেই চেষ্টা চলছে। ওদের যে কীসের সমস্যা বুঝতে পারছি না। একটা চায়ের দোকানের পাশে অন্য কেউ দোকান করলে কি সেই দোকান চলে না?’’ রূপার স্বামী এখন আর তাঁর সঙ্গে থাকেন না। এক ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে রূপা ভাড়া থাকেন হরিদেবপুরে। বাপের বাড়ি টালিগঞ্জ এলাকার ঝোড়োবস্তিতে। এত দিন বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করতেন। বললেন, ‘‘অটোয় রোজগার বেশি। তাই অটোই চালাব ঠিক করেছি। আমরা চালালে অটোর সংখ্যা বাড়বে। তাতে যাত্রীদেরও তো সুবিধা হবে।’’

আরও পড়ুন: প্রয়োজনে অন্য রুটে চালাবেন মহিলারা

কৃষ্ণার অনুমান, তাঁর স্বামীও ওই রুটেই অটো চালান বলে তাঁকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার স্বামী ওই লাইনেই অটো চালান। যখন মেয়েরা অটো চালাবে শুনলাম, তখন আমিও রাজি হয়ে গেলাম। শিখেও নিয়েছি। কিন্তু এখন বোধহয় সেটাই আমার কাল হল। কার এতে কী অসুবিধা, সেটাই তো বুঝছি না।’’ তবে হার মানেননি তন্দ্রা। হাজরা রুটে না পারলেও নিজেই টালিগঞ্জ ফাঁড়ি এলাকায় কাটা রুটে রাত আটটা থেকে সাড়ে ন’টা পর্যন্ত ভাড়ার অটো চালান তিনি। বলছেন, ‘‘দেখি, কে আটকায়!’’

ওই রুটেরই অনেক পুরুষ চালকের আশঙ্কা, মেয়েরা অটো চালালে মহিলা যাত্রীরা সেই অটোতেই উঠবেন। ফলে মার খাবে পুরুষদের রোজগার। এক চালকের কথায়, ‘‘এই রুটে বহু মহিলা যাত্রী। তাঁরা মহিলাদের গাড়িতেই উঠবেন। এতেই ভয় পাচ্ছে কয়েক জন। নিরাপত্তার অজুহাতে মহিলা চালকদের যে বাধা দেওয়া হচ্ছে, এটা সরকারের জানা উচিত।’’

নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন শুনে চেঁচিয়ে উঠলেন রূপা। বললেন, ‘‘বিপদে পড়লে নিজেরাই প্রতিবাদ করব। তবে বাঁচানোর জন্য কোনও ছেলেকে ডাকব না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE