Advertisement
E-Paper

দশ আঙুল হারাচ্ছে অতীতের ছন্দ

আনকোরা মক্কেলকে রীতিমতো পথও বাতলে দিতেন টাইপিস্টরা। বছর বিশেক আগের কথা। রোজকার মতো দোকান খুলে টাইপ করছেন কোর্টপাড়ার প্রবীণ টাইপিস্ট সুব্রতবাবু।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৮ ০২:১৬
স্মৃতিময়: ক্ষয়ে যাওয়া টাইপ মেশিন এখনও আঁকড়ে কাজ করে চলেছেন ওঁরা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

স্মৃতিময়: ক্ষয়ে যাওয়া টাইপ মেশিন এখনও আঁকড়ে কাজ করে চলেছেন ওঁরা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

কয়েক দশক আগের কথা। হাইকোর্ট পাড়ায় ‘টন্ডন’ সাহেবের দফতর ‘খটাখট’ শব্দে ভরে থাকত। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অন্তত জনা বিশেক নানা বয়সি মানুষ যন্ত্রে মুখ গুঁজে মগ্ন থাকতেন মোকদ্দমার নথি তৈরিতে!

শতাব্দীপ্রাচীন বা়ড়িটার গা ঘেঁষেই চেয়ার-টেবিল পেতে চলত ‘আপিস’। দশ আঙুলের ছন্দে সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামত অন্যদের মতো সুব্রত চট্টোপাধ্যায়েরও। ক্যালেন্ডারে পাতা উল্টোনোর সঙ্গে বদলে গিয়েছে সেই হাইকোর্ট পাড়া। প্রযুক্তির অগ্রগতিতে মিলিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রের ছন্দ, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন ওঁরাও। কোর্টপাড়ার টাইপিস্টরা!

এক কালে রেমিংটনের টাইপ মেশিন ছিল বিখ্যাত। সে সংস্থা তো কবেই পাট চুকিয়েছে। তার পরেও আর একটি বেসরকারি সংস্থা টাইপ মেশিন তৈরি করত। বছর কয়েক আগে তারাও উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে নতুন করে যন্ত্র কেনার উপায় নেই। যন্ত্র খারাপ হলে সারানোর লোকও হাতে-গোনা। টাইপ মেশিনের মতো তাঁরাও অশীতিপর বৃদ্ধ। প্রযুক্তির হাত ধরে সে জায়গা নিয়েছে কম্পিউটার। এখন কম্পিউটারে টাইপ করেই মোকদ্দমার নথি তৈরি হয়। হাইকোর্টের আইনজীবী পৌষালি বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘কে এখন টাইপের ঝক্কি নেবে? কম্পিউটারে নথি করলে তা শুধরোনোও সোজা।’’

কিন্তু স্মৃতি তো রয়েই যায়! অলস দুপুরে চা হাতে জমিয়ে বসলে সে সব গপ্পো শুনতে মন্দ লাগে না। এক কালে হাইকোর্ট, ব্যাঙ্কশাল কোর্ট, সিটি সিভিল কোর্ট চত্বর পাড়ায় গিজগিজ করতেন টাইপিস্টরা। দিনরাত আঙুলে ঝড় তুলে মোকদ্দমার নথি করতেন তাঁরা। সে আমলে তো মাধ্যমিক পাশ করলেই পাড়ার টাইপ শেখার স্কুলে নাম লেখাতে হত। কলেজ পেরিয়ে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে ঢুকতে হলে টাইপের জ্ঞান দরকার হত। এই জ্ঞান দিয়ে কত কী করা যায়, তা উঠে এসেছিল ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ সিনেমায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রমা গুপ্তের চরিত্রে।

আনকোরা মক্কেলকে রীতিমতো পথও বাতলে দিতেন টাইপিস্টরা। বছর বিশেক আগের কথা। রোজকার মতো দোকান খুলে টাইপ করছেন কোর্টপাড়ার প্রবীণ টাইপিস্ট সুব্রতবাবু। এমন সময়ে হাজির উত্তর ২৪ পরগনার কয়েক জন যুবক। তাঁরা পুরসভার কর্মী। দশ বছর চাকরি করার পরে আচমকাই ছাঁটাই করা হয়েছে তাঁদের। টাকা জোগাড় করে মামলা করবেন, কিন্তু ভরসা পাচ্ছেন না। জাঁদরেল উকিল না পেলে তো শেষ সম্বলটুকুও যাবে! সুব্রতবাবু বলছেন, ‘‘সব শুনে পাঠালাম এক জাঁদরেল উকিলের কাছে। দক্ষিণাও পেলাম। এক শুনানিতেই ফের চাকরিতে বহাল হলেন ওঁরা!’’

শোনা যায়, সে কালের অনেক টাইপিস্টদের বাঁধা উকিল থাকত। শাঁসালো মক্কেল দেখলেই ঢুকিয়ে দিতেন সাহেবের চেম্বারে! বিনিময়ে দক্ষিণাও জুটত। কেউ কেউ আবার টাইপ করতে করতে মোকদ্দমার নথি তৈরিতে এমন ওস্তাদ হয়েছিলেন যে উকিলের চিরকুট দেখেই পাকা নথি তৈরি করে দিতেন। এমনই এক জন ছিলেন অজয় নায়েক। বছর দুয়েক আগে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর স্মৃতি এখনও অমলিন। সুব্রতবাবুই বলছিলেন, ‘‘মোকদ্দমার নথি তৈরিতে অনেক উকিলের থেকে বেশি জ্ঞান ছিল অজয়দার।’’

হাপিত্যেশও কম নেই! এক কালে টাইপ করে কম আয় হত না। এই নেশায় বহু লোক সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার বার কয়েক পিএসসি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ ঘাঁটি গে়ড়েছিলেন এই পাড়ায়। প্রযুক্তির পালাবদলের পরে আয় কমেছে অনেকটাই। লাগাতার কর্মবিরতির নিরালা দুপুরে তাই আক্ষেপ শোনা যায়, ‘‘কোনও সওদাগরি আপিসে কাজ করলেও এর থেকে বেশি আয় হত।’’

তবে এখনও জমি, বাড়ির দলিল, চুক্তিপত্রের চূড়ান্ত নথি তৈরিতে টাইপই ভরসা। কিছু সরকারি গোপন নথিও টাইপ করে রাখা হয়। কারণ টাইপের কালি চট করে নষ্ট হয় না। কম্পিউটারের ফাইল নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে প়ড়তে পারে, বলছিলেন লড়াই চালিয়ে যাওয়া রমা গুপ্তরা।

আজও তাই কোর্টপাড়ায় কান পাতলে শোনা যায় খটাখট খটখট।

Type machine typists Computer
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy