পুলিশি ঘেরাটোপের ফাঁক গলে আকাশবাণী ভবনের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ছাই রঙের পুঁচকে গাড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে রে রে করে ছুটে গেলেন পুলিশ অফিসার ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রধারী কমব্যাট ব্যাটেলিয়নের সদস্যরা।
শনিবার সকাল তখন পৌনে সাতটা। দু’শো মিটার দূরেই রেড রোডে প্রজাতন্ত্র দিবসে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের মহড়া তত ক্ষণে শুরু হয়েছে। তার ছবি তুলতে ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউয়ে পুলিশের রাখা বাঁশ ও কাঠের ব্যারিকেডে উঠেছিলেন জনা কয়েক প্রাতর্ভ্রমণকারী। পুলিশ প্রথমে বারণ করে। তার পরেও না-শোনায় জোর করে নামিয়ে দেওয়া হল তাঁদের।
এই সব দেখেশুনে পথচারী এক প্রবীণের মন্তব্য, ‘‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে! এ সব আগে করলে এক তরুণ সেনা অফিসারকে বেঘোরে মরতে হতো না।’’
গত ১৩ জানুয়ারি সকালে সোহরাব পরিবারের বেপরোয়া গাড়ি পুলিশি ঘেরাটোপ ভেঙে রেড রোডে ঢুকে কুচকাওয়াজের মহড়ায় অংশ নেওয়া বায়ুসেনার কর্পোরাল অভিমন্যু গৌড়কে পিষে দেয়। তার পরেই সেনা কুচকাওয়াজের জন্য বরাদ্দ পুলিশি নিরাপত্তা ও তৎপরতা বেড়ে গিয়েছে কয়েক গুণ। যা দেখা গেল রেড রোডের আশপাশে ময়দান তল্লাটেই।
গত বুধবার সকালের ঘাতক গাড়ি গার্ডরেল দিয়ে করা পুলিশের তিনটি ব্যারিকেড ভেঙে দিয়েছিল। আর এ দিন রেড রোডের চতুর্দিকে দেখা গেল ত্রিস্তরীয় ব্যারিকেড। প্রথমে গার্ডরেল, তার পর কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ‘সিজার ব্যারিকেড’ এবং তার পরে পুলিশের চার-পাঁচটি করে গাড়ি আড়াআড়ি রাখা। মহড়া শুরু হওয়ার দু’ঘণ্টা আগে, ভোর সাড়ে চারটে থেকে ওই সব ব্যারিকেড তৈরি করেছিল পুলিশ।
জংলা পোশাক পরা, কমব্যাট ব্যাটেলিয়নের ৩৪ জন পুলিশকে মোতায়েন করা হয়েছে, যাঁরা প্রত্যেকেই কম্যান্ডো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সবারই হাতিয়ার স্বয়ংক্রিয় ইনস্যাস রাইফেল। এ ছাড়া মেশিন কার্বাইন, সেল্ফ লোডেড রাইফেল নিয়ে আরও শ’দেড়েক পুলিশ। পিস্তল নিয়ে, লাঠি হাতে এবং খালি হাতেও ছিলেন আরও বহু পুলিশ। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচশো পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল বলে লালবাজার সূত্রের খবর।
জনা দশেক ইনস্পেক্টরের দায়িত্বে কুচকাওয়াজের মহড়ার জায়গা রেড রোডের চার পাশের গোটা এলাকাকে ৩০টি পয়েন্টে ভাগ করা হয়েছিল এ দিন। তাঁদের উপরে তিন জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। আবার তাঁদেরও মাথায় ডিসি সাউথ মুরলীধর শর্মা, ডিসি ট্রাফিক সলোমন নেসাকুমার এবং প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম ব্যাটেলিয়ন আর কমব্যাট ব্যাটেলিয়নের ডিসি-রা। সশস্ত্র পুলিশের যুগ্ম কমিশনার সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে।
মহড়া শুরু আগে পুরো রেড রোড তন্নতন্ন করে তল্লাশির পরে লাগোয়া এলাকার ভিডিওগ্রাফিও করে রাখা হয়। পাশে ডাফরিন রোড ছাড়া আশপাশের রাস্তাগুলিতে সাধারণ গাড়ির গতি কমাতে ব্যবস্থা নিয়েছিল ট্রাফিক পুলিশ। সেই ভাবেই গার্ডরেল বসানো হয়েছিল আঁকাবাঁকা করে। ডাফরিন রোডের গাড়িগুলিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় আউট্রাম রোডের দিকে। এক পুলিশকর্মীর কথায়— ‘‘ভোর তিনটে থেকে ছোটাছুটি চলছে। ভালয় ভালয় মিটলে বাঁচি।’’
৩০ ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত কুচকাওয়াজের মহড়া হয়েছে ন’দিন। ওই ন’দিন খাতায়-কলমে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন এক জন ডেপুটি কমিশনার। কিন্তু বাস্তবে রাস্তায় নেমে নিরাপত্তা দেখভাল করেন দু’জন ইনস্পেক্টর। রেড রোডে আসা যাওয়ার বিভিন্ন অংশকে ন’টি ভাগে ভাগ করা ছিল। প্রতিটির দায়িত্বে ছিলেন এক জন সাব-ইনস্পেক্টর বা সার্জেন্ট। সঙ্গে দু’জন বন্দুকধারী পুলিশ।
এমন নিরাপত্তার বহর চলে আসছিল সেই আশির দশক থেকেই। লালবাজারের কর্তারা নিজে থেকে তাতে বদল আনার কথা ভাবেননি। এমনকী, আমেরিকান সেন্টারের সামনে জঙ্গি হামলার পরেও নয়। ২০০২-এর ২২ জানুয়ারির সেই সকালেও কিন্তু সেনা-কুচকাওয়াজের মহড়া চলছিল রেড রোডে। এর পর আরও চার দিন মহড়া। ১৮, ২০, ২২ ও ২৪ তারিখ। লালবাজারের কর্তারা জানাচ্ছেন, ওই চার দিনও থাকবে ব্যাপক পুলিশি বন্দোবস্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy